সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সৎ, নির্মোহ, জনবান্ধব ও মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার সকালে সেনাসদর নির্বাচনী পর্ষদ-২০২১-এর প্রথম পর্বের সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
সেনাসদর নির্বাচনী পর্ষদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এ কর্মসূচিতে স্বশরীরেই উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ বছর করোনা মহামারির কারণে নির্বাচনী পর্ষদে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হলেন তিনি।
অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন
দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখতে একটি সুশৃঙ্খল ও অত্যাধুনিক সেনাবাহিনী অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বলীয়ান, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগে সদা প্রস্তুত, পেশাদার এবং দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তাদের হাতে এর নেতৃত্ব ন্যাস্ত করতে হবে।
‘শৃঙ্খলাই সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড। সেই সঙ্গে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সৎ, নির্মোহ, ন্যায়পরায়ণ, জনবান্ধব, মানবিক গুণসম্পন্ন এবং সর্বপরি কর্মজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদানে সফল অফিসারদের খুঁজে বের করতে হবে।’
সেনা কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য ট্যাবুলেটেড রেকর্ড অ্যান্ড কমপারেটিভ এভালুয়েশন (টিআরএসিই) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় যা তাদের পেশাগত দক্ষতার বিভিন্ন দিকের তুলনামূলক মূল্যায়ন প্রকাশ করে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সেই সঙ্গে নির্বাচকমন্ডলীগণ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকেই পদোন্নতির জন্য নির্বাচিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস।’
‘আপনাদেরকে সব প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে। বিভিন্ন প্রকার নিযুক্তি যেমন-কমান্ড, স্টাফ, প্রশিক্ষকসহ বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ নিযুক্তির জন্য উপযুক্ত অফিসারদেরকে পদোন্নতি প্রদান করতে হবে। এতে করে সকলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে অগ্রযত্রা শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নিবিড় পরিচর্যার ফলে এই বাহিনী বর্তমানে অত্যন্ত পেশাদার, দক্ষ ও আধুনিক বাহিনীতে পরিণত।
‘সম্প্রতিক সময়ে করোনা মহামারি প্রতিরোধসহ নানা উন্নয়ন এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলছে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুধু দেশেই নয় বিশ্ব দরবার থেকেও দেশের জন্য এক বিরল সম্মান ও মর্যাদা বয়ে এনেছে।’
জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সুশৃঙ্খল, উন্নত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেও জানান বঙ্গবন্ধু কন্যা। তুলে ধরেন সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে জাতির পিতার নেয়া নানা পদক্ষেপের কথা।
তিনি বলেন, “তিনি (বঙ্গবন্ধু) গণপরিষদে খসড়া সংবিধান অনুমোদনের সময় বলেছিলেন, ‘শাসনতন্ত্র ছাড়া, মৌলিক অধিকার ছাড়া দেশের অবস্থা হয় মাঝিহীন নৌকার মত।”
তিনি জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শর্তে আন্তর্জাতিক শান্তি,নিরাপত্তা ও সংহতি উন্নয়নে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সেই সংবিধানের ২৫-নং অনুচ্ছেদে স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি রচনা করে দিয়েছেন।
‘জাতির পিতা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে রূপান্তরিত করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেইদিন বিদেশে থাকায় ছোট বোন শেখ রেহনাসহ প্রাণে বেঁচে যাই। জাতির পিতাকে হত্যার পর ৬ বছর পর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে জনগণ ও নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে দলের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার সর্বদাই জনগণের সেবক হিসেবে দেশ পরিচালনা করে, কখনোই শাসক হিসেবে নয়।’
এ সময় সরকার গঠনের পর থেকে সামরিক বাহিনীকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপেরও কথাও তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
তিনি বলেন, ‘গত সাড়ে ১২ বছরে আমরা আমাদের তিন বাহিনীর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেনাবাহিনীতে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র, সেনা বিমান ও হেলিকপ্টারসহ আধুনিক ইনফ্যান্ট্রি গেজেট, ইঞ্জিনিয়ারিং সরমঞ্জামাদি সংযোজন করেছি।’
‘করোনাভাইরাস মহামারির সংক্রমণের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে নেই। আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদণ্ডে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছি এবং মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছি। আর্থ-সামাজিক সকল সূচকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছি।’
করোনা মহামারির সময়ও সব মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। সরকার প্রধান বলেন, ‘আমরা সকল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছি, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রেরণ করেছি। দেশকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করেছি।’
‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। রূপকল্প-২০২১ এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করেছি।’
পদোন্নতি পাওয়া সেনা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীকে আগামীতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ২০০৮-এর নির্বাচনের ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব ঘোষণা দিয়েছিলাম। আজকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এই করোনাকালেও সকলে এখানে উপস্থিত হতে পেরেছেন, সুস্থ আছেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আপনাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।’
‘এই সময় আমি জানি, আপনারা যোগ্য অফিসারদেরই পদোন্নতি দেবেন, যারা আগামীতে এই সেনাবাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ প্রদানের আগে সেনাসদর মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্স প্রান্ত থেকে সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।