শাটডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া বিধিনিষেধের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষার জন্য গত বছর অনুত্তীর্ণ শতাধিক পরীক্ষার্থীকে বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থীদেরকে ডেকে আনলেও তারা নিবন্ধন করতে পারেনি।
যান চলাচল বন্ধ থাকা অবস্থায় নানা হয়রানির মধ্যে বার কাউন্সিলে এসে তারা ব্যাংক ও বিভিন্ন শাখা বন্ধ পান। আর এতে ক্ষোভের পর মৌখিক পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল আগামী ২৫ জুলাই থেকে। বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় এমসিকিউ পাসের পর লিখিত পরীক্ষায় ফেল করলে পরেরবার তিনি এমসিকিউ ছাড়াই লিখিত পরীক্ষায় বসতে পারেন। আবার কেউ ভাইভায় ফেল করলে পরেরবার তিনি লিখিত না দিয়েই আবার মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন।
গত বছর মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ আড়াইশর মতো পরীক্ষার্থীকে আবার নিবন্ধনের জন্য রোববার ডাকা হয় বার কাউন্সিলে। কিন্তু যান চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই আসতে পারেননি। আর ঢাকায় থাকা যারা সেখানে গিয়েছেন, তাদেরেক নানা ঝক্কি ঝামেলা সয়েই যেতে হয়েছে।
পরে রাতে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, তারা ফরম পূরণ পিছিয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করেছেন।
মৌখিক পরীক্ষা কবে নেয়া হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওইটা আমরা এখনও ঠিক করি নাই। পরিস্থিতি দেখে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
তবে এ বিষয়ে অফিস আদেশ এখনও জারি হয়নি। আর বিষয়টি নিয়ে জানতে বার কাউন্সিল সচিব রফিকুল ইসলামকে ফোন দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
পরে তার নামে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, হাইকোর্ট পারমিশন বিভাগের ফরম ফিলাম এবং অ্যাডভোকেটশিপ তালিকাভুক্তির কার্যক্রমের জন্য সীমিত আকারে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অফিস খোলা হইলেও করোনা মহামারির কারণে সরকারঘোষিত লকডাউনের জন্য পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অফিস কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
‘উল্লেখ্য যে, হাইকোর্ট পারমিশন বিভাগের ফরম ফিলাপ ৩১ আগস্ট ২০২১ ইং পর্যন্ত অনলাইনে চলমান থাকিবে।’
শাটডাউনে পরীক্ষার্থীদের ডেকে ভোগান্তির পর অফিস বন্ধ ঘোষণা করে বার কাউন্সিলের বিজ্ঞপ্তি
শাটডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার এবার বেশ কঠোর। ৯ দিনে কেবল ঢাকায় যৌক্তিক কারণ দেখাতে তা পারায় জরিমানা আদায় করা হয়েছে দেড় কোটি টাকা। আটকের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। ঢাকার বাইরে এই সংখ্যাটি আরও বড়।
এর মধ্যে বার কাউন্সিল আইনজীবী নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষার জন্য তারিখ ঘোষণা করে আগামী ২৫ জুলাই। সে পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত হতে পারে কি না, এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে গতবার যারা পাস করতে পারেননি, তাদের এবারের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণের জন্য কাউন্সিলে ডাকা হয়।
বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, এদের ফরম ফিলাপের জন্য ১১ জুলাই থেকে বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট, রেজিস্ট্রেশন শাখা এবং ডেসপাচ শাখাগুলো খোলা রাখা হবে।
ভোগান্তি চরমে
বার কাউন্সিলের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ফরম ফিলাপের জন্য রামপুরা বাসা থেকে সকালে বের হন স্বপন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রিকসায় করে দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় কাউন্সিল ভবনে পৌঁছেন।
পথে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে জেরার মুখে পড়তে হয়েছে একাধিকবার। অনুরোধ করে আসতে পেরেছেন গন্তব্যে।
তবে এত কষ্ট করে বার কাউন্সিলে যেতে পারলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শাটডাউনের মধ্যে শুক্র ও শনিবারের পাশাপাশি ব্যাংক রোববারও বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে টাকা জমা দেয়া যায়নি, ফরমও পূরণও হয়নি।
এরপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে আবার রিকসা ভাড়া করে বাসায় ফেরত আসতে হয়েছে।
একই অভিজ্ঞতা শতাধিক পরীক্ষার্থীর।
তবে ঢাকার বাইরে থাকা এন নারী পরীক্ষার্থীর এক বছর বয়সী বাচ্চা আছে। এখন আছেন নওগাঁয়। গত বছর ভাইভাতে বাদ পড়েন। এবার আবার পরীক্ষায় অংশ নিতে চান।
যখন গাড়ি চলাচল বন্ধ, ঢাকায় ঢোকা নিষেধ, তখন কীভাবে তিনি আসবেন, সেটি জানেন না।
তিনি বলেন, ‘ছেলেরা তো না হলে বাইক দিয়ে যেতে পারবে। আমি শিশু সন্তান নিয়ে কীভাবে এই পরিস্থিতির মধ্যে যাব। এটি বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ একবারও ভাবলে না!’
আরেক পরীক্ষার্থীর বাড়ি ফেনীতে। শাটডাউন দেয়ার আগেই চলে যান সেখানে।
তিনি বলেন, ‘গাড়ি তো চলে না। ঢাকায় যাব কীভাবে। এ অবস্থায় মহাবিপদে পড়েছি মনে হচ্ছে।’
এ নিয়ে বার কাউন্সিলের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন ধরেননি প্রতিষ্ঠানটির সচিব।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম সোহেল এই সময়ে বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেয়া আর ফরম পূরণের জন্য ডাকাকে দুর্ভাগ্যজনক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন পঞ্চগড় থেকে একজন কীভাবে আসবে? সড়কে গাড়ি বন্ধ, লঞ্চ বন্ধ, ফেরি বন্ধ। এ অবস্থায় বার কাউন্সিল পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তো মনে হয় না।’
বার কাউন্সিলে আইনজীবীদের সনদ পেতে নৈর্ব্যক্তিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আবার ওই তিন ধাপের যে কোনো একটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা একবার উত্তীর্ণ হলে পরবর্তী পরীক্ষায় তারা দ্বিতীয়বার অংশ নেয়ার সুযোগ পান।
সে অনুসারে ২০১৭ সালের ৩৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে থেকে লিখিত পরীক্ষায় বাদ পড়া ৩ হাজার ৫৯০ জন শিক্ষার্থী এবার লিখিত পরীক্ষা দিতে পেরেছেন।
২০২০ সালে ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষানবিশ আইনজীবী নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে পাস করেন ৮ হাজার ৭৬৪ জন। তাদের সঙ্গে গতবার বাদ পড়াসহ মোট ১২ হাজার ৮৫৮ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় লিখিত পরীক্ষা হয়। ১৯ ডিসেম্বরের পরীক্ষায় পাঁচটি কেন্দ্রে গোলযোগের কারণে সেগুলোতে পরীক্ষা স্থগিত হয়। পরে এই পরীক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দফায় লিখিত পরীক্ষা দেন।
লিখিততে উত্তীর্ণরা এখন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেবেন। এখানে পাস করলেই আদালতে আইনজীবী হিসেবে পেশাগত কাজ শুরু করবেন শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা।
আইনজীবী নিবন্ধনের পরীক্ষা বছরে দুটি হওয়ার কথা। কিন্তু সবশেষ পরীক্ষা হয়েছে ২০১৭ সালে। এ কারণে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ আছে। কারণ, পরীক্ষা ছাড়া আইন পেশায় যুক্ত হওয়া যায় না। কেবল অন্য আইনজীবীর সঙ্গে ‘শিক্ষানবিশ’ হিসেবে যুক্ত থাকা যায়। আর এ অবস্থায় আয়ের সুযোগ একেবারেই সীমিত। ‘সিনিয়র’ আইনজীবী তার ইচ্ছামাফিক যত টাকা দেন, তার ওপরই নির্ভর করতে হয়।