পাচারকারীর খপ্পরে মরিশাস গিয়ে ধর্ষণের শিকার এক নারী দেশে ফিরে মামলা করেছেন। তার বাবাকে সেখানে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। দেশে ফেরার কয়েক মাস পর তরুণী মামলা করায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাচারচক্রের এক সদস্যকে।
ওই তরুণীর বাসা রাজধানীর দক্ষিণখানে। বাবা কাপড়ের ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে গোটা পরিবার আর্থিকভাবে বিপাকে পড়ে যায়।
এ অবস্থায় তার বাবা সংসারের খরচ জোগাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এক বন্ধুর পরামর্শে চাকরির সন্ধানে পরিচিত এক জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সির খোঁজ পান তিনি। এজেন্সির লোকজন বাবার বয়স বেশি হয়েছে জানিয়ে ওই তরুণীকে মরিশাসে চাকরি দিতে আগ্রহ দেখায়।
তারা সেখানে তাকে গার্মেন্টসে কাজ দেবে বলে জানায়। এর পরই প্রতারণা আর নির্যাতনের চক্রে পড়ে যান তিনি।
রামপুরা থানায় গত ৯ জুলাই করা মামলার এজাহারে ওই তরুণী বলেছেন, আফ্রিকার দ্বীপ দেশ মরিশাসে নেয়ার পর পোশাক কারখানার মালিকসহ একাধিক ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন।
তারা হুমকি দেন, দেশে ফিরলে কাউকে কোনো অভিযোগ করা যাবে না। অভিযোগ করা হলে তাদের হাতে জিম্মি তার বাবাকে মেরে ফেলা হবে।
কোনো অভিযোগ করবে না এমন শর্তে মুক্তি পেয়ে অবশেষে দেশে আসেন ওই তরুণী। তবে তার বাবা এখনও মরিশাসে আসামিদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন।
ওই তরুণী নিউজবাংলাকে জানান, ধর্ষণের কারণে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন মরিশাসে। আসামিরা সেখানে তাকে গর্ভপাত করান একটি হাসপাতালে। এতে তার জরায়ুতে সংক্রমণ ধরা পড়ে।
চিকিৎসক জানিয়েছেন, এই ইনফেকশনের কারণে তার জরায়ুতে টিউমার অথবা ক্যানসার হতে পারে। তিনি এখন ব্র্যাকের মাধ্যমে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
শনিবার বিকেলে রামপুরা থানায় ওই তরুণী মানবপাচার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আলাদা ধারায় একটা মামলা করেছেন।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় আকবর হোসেনকে। তিনি মেসার্স গোলাম রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।
বাকি আসামিরা হলেন গোলাম রাব্বি, আক্তার হোসেন, শাহ আলম, ফোরকান, সিদ্দিক, আসলাম, ভারতীয় নাগরিক অনিল কোহলি এবং অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জন।
২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে ফেরার তিন দিনের মাথায় রাতের আঁধারে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই তরুণী। কিন্তু তার বোন দেখে ফেলেন ও তা ঠেকান।
এরপর তার সঙ্গে মরিশাসে হয়ে যাওয়া বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলেন বড় বোনকে। বড় বোন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসাসহ কাউন্সেলিং দেয়া হয়।
ওই তরুণী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সহায়তা চেয়েছেন। মন্ত্রণালয় তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
মরিশাসে নিয়ে ধর্ষণ
নিউজবাংলাকে ওই তরুণী বলেন, ‘আমাকে ও আমার পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে মরিশাস নেয়া হয়েছে। প্রথমে আমি যেতে রাজি হই নাই। আমার বাবাকে পাঠাতে চাইছিলাম। এজেন্সির লোকেরা বলে আমার বাবার বয়স বেশি তাই তার ভিসা পেতে ঝামেলা হবে। আমি গিয়ে বাবাকে নিতে পারব। এরপর মরিশাসে নিয়ে অনিল কোহলি নামে একজন প্রথমে আমাকে ধর্ষণ করেন। তিনি ভারতীয় নাগরিক ও ওই কোম্পানির মালিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ষণের কয়েকদিন পর চিকিৎসকের কাছে আমায় নেয়া হলে তিনি জানান আমি অন্তঃসত্ত্বা। শাহআলম নামে ওই কারখানার একজন একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আমার গর্ভপাত করায়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
‘গর্ভপাতের পরে শাহআলম তার বাসায় রেখে আমাকে ধর্ষণ করে। আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে আমার বাবাকে মরিশাসে নিয়ে যায় তারা। এক পর্যায়ে আমাকে দেশে পাঠায়। তবে বাবাকে জিম্মায় রেখে দেয়। বাবাকে মেরে ফেলার ভয়ও দেখায় তারা। তাই দেশে এসে এতো দিন আমি থানা-পুলিশকে কিছু বলি নাই।’
রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিকটিম যে ঘটনা নিয়ে আসছেন, আমরা তার ওপর ভিত্তি করে মামলা নিয়েছি। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’
ভিকটিমের আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নারীরা আইন না জেনেই চাকরির লোভে বিদেশে যায়। সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হন – এরকম ঘটনা অনেক। খুব কম সংখ্যক নারী আছেন, যারা বিচারের প্রত্যাশায় আসেন এবং বিচার পান। সে সকল নারী বিদেশে গিয়ে কাজ করছেন এবং যৌন নির্যাতনের শিকার, তাদের প্রতি আমার আহ্বান হচ্ছে, আপনারা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটা জানাবেন এবং আইনি সহায়তা নিবেন। আপনারা সবাই এগিয়ে আসলে দোষীদের বিচার হবেই।’
ব্র্যাকের অভিবাসনবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘ভুক্তভোগী এই নারী যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটি ভয়াবহ। বিদেশে কাজের কথা বলে কাউকে যৌন নিপীড়ন করা বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো মানবপাচারের মধ্যে পড়ে।
‘মরিশাস এবং বাংলাদেশ সরকারের উচিত যৌথভাবে এই ঘটনার তদন্ত করা। আরও কোনো বাংলদেশি নারী এমন নিপীড়নের শিকার কি না, সেটিও খুঁজে বের করে বিচার করা উচিত। আশা করছি মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। আর বাংলাদেশেও যেহেতু মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে সেটিরও যথাযথ তদন্ত ও বিচার হবে বলে আশা করি।’
এ ঘটনায় শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় গ্রেপ্তার করা হয় রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আক্তার হোসেনকে। মালিবাগ আবুল হোটেল সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে নিশ্চিত করেন রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম।