নানারকম অনিয়মের ভেতর দিয়ে রূপগঞ্জের ভুলতায় গড়ে তোলা হয়েছিল হাশেম ফুড অ্যান্ড ব্যাভারেজ লিমিটেড কারখানা। ভবনের নকশাই অনুমোদন করা হয়নি। মানা হয়নি ইমারত নির্মাণ বিষয়ক বিধি। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাতে ছিল অবহেলা।
অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
তারা বলেছেন, শুধু যাত্রার শুরু থেকে নয়, উৎপাদনে এসেও একের পর এক লঙ্ঘন করা হয়েছে নিয়ম-কানুন। ছিল না নিরাপদ কর্মপরিবেশ। শ্রমিকদের কাজ করার স্থলেই রাখা হতো ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থ। ফায়ার অ্যালার্ম, ইমারজেন্সি এক্সিট ডোর, হাইড্রেন্ট সিস্টেমের মতো পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ঘাটতি ছিল।
বিশাল ভবনে দুটি সিঁড়ি ছিল। কিন্তু প্রতিটি ফ্লোরে সিঁড়ি লোহার জালের পার্টিশনে ঘেরা এবং তা তালাবদ্ধ রাখার কারণে কর্মঘণ্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই সিঁড়ি দিয়ে কখনই নামতে পারত না শ্রমিকরা।
ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ইসসাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. মঞ্জুর আলম নিউজবাংলাকে জানান, বাণিজ্যিক ভবনে সাধারণত যে ধরনের স্প্রিংকলার সিস্টেম এবং হাইড্রেন্ট সিস্টেম থাকে, তার কোনো পয়েন্ট তারা ওই কারখানায় দেখতে পাননি। ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেমেরও কোনো আয়োজন তাদের চোখে পড়েনি।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা এখানে ফায়ার এক্সিটটা ভালভাবে ছিল না। ফায়ার ডোর এবং জরুরি নির্গমন পথ বিধি অনুযায়ী হয়নি। শুনেছি ১৮০ জন শ্রমিক নাকি কাজ করছিল। যদি পর্যাপ্ত ইভ্যাকুয়েশন সিস্টেম থাকত, তাহলে শ্রমিকরা সহজে বের হতে পারত। সেদিক থেকে আমরা কোনো ভবন নিরাপত্তার বিধি মানার কোনো স্পষ্ট প্রতিফলন পাইনি।’
ইসসাব-এর পরিচালক জাকির উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এখানে ইমারত নির্মাণ বিধি, ফায়ার সেফটি কোনোটিরই প্রতিফলন দেখা যায়নি। দাহ্য পদার্থ যেখানে সংরক্ষণ করা হবে, সেটিকে ফায়ার ইটের ওয়াল দিয়ে ঘেরাও করে সেফটি নিশ্চিত করার কথা। এগুলো যারা প্রফেশনাল, তারা সবাই জানে। কিন্তু আমরা এখানে অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, এর ব্যত্যয় ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধির চতুর্থ অধ্যায়ে বলা আছে, কীভাবে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এখানে অবশ্যই তার বড় আকারের ব্যত্যয় আছে। আর ব্যত্যয় আছে বলেই ৪৯টা তাজা প্রাণ হারাতে হয়েছে।’
এই বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী প্রাথমিক পরিদর্শন শেষে নিজস্ব মতামত দিয়ে বলেন, ‘ভবনের প্রতিটি ফ্লোর পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা ছিল। এখানে কাঁচামাল থাকার কারণে এবং মেশিনারিজ থাকার কারণে আপিন যে সোজা দৌঁড়ে চলে যাবেন, সে রকম পরিস্থিতি ছিল না।
‘মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যেভাবে ম্যাটিরিয়ালগুলো রেখেছিল, এগুলোই মূলত শ্রমিকগুলোর বাঁচার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করেছে। সম্পূর্ণ ভবনে মাত্র দুটি সিঁড়ি আমরা পেয়েছি। সামনের দিকে যে সিঁড়ি, সেটা আগুনের কারণেই বন্ধ ছিল, ব্লক ছিল। ওটা বাদ দিলে দ্বিতীয় সিঁড়ি ছিল মাত্র একটা। এই কারণে হয়তো শ্রমিকরা তা ব্যবহার করতে পারেনি। তারা হয় ছাদে অথবা ভূমিতে চলে আসতে পারেনি।’
এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী মো. মাহমুদুর রশিদ জানান, ‘দুর্ঘটনার প্রকৌশলগত কী ত্রুটি ছিল এবং তা কীভাবে রিকভারি করা যেত, আমরা সেটি প্রাথমিক যাচাই করেছি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের যত ধরনের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন আছে, যে ফায়ার সেফটি কোড অফ কন্ডাক্ট আছে, তার অনেকাংশই এখানে অনুসরণ হয়নি।’
তিনি বলেন, প্রতিটি ভবনের আগে নকশা তৈরি করা হয়, তারপর ভবন তৈরি হয়। এখানে এটার ব্যত্যয় ঘটেছে। তারা আগে বিল্ডিং করেছে, উৎপাদনে এসেছে। যতোটুকু তথ্য পেয়েছি, নকশার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও তারা অনুমোদন পায়নি। অথচ আজকে এতো বছর ধরে এই ফ্যাক্টরি চলছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রশিদ বলেন, ‘এখানে একটা ইমারজেন্সি ফায়ার এক্সিট ডোর নেই। এতোগুলো মানুষের প্রাণ চলে গেল। এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? আমরা সবাইকে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের ভবনকে নিরাপদ করার জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকে অ্যাপ্রুভাল নেবেন।’
হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজে নিরাপত্তার বিধিবিধান মানা হচ্ছে কিনা কি-না সেটি দেখার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় কলকারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তর অফিসের। মুঠোফোনে এ অফিসের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে প্রত্যেকটা কল-কারখানায় আমাদের ইন্সপেক্টররা নিয়মিত পরিদর্শন করেন। যদি কোনো ত্রুটি পান, তাদেরকে নোটিশ দেয়া হয়। বিভিন্নভাবে তাদের উৎসাহিত করা হয়, যাতে তারা স্ট্যান্ডার্ডটা মেইনেটইন করেন এবং প্ল্যানটা অনুমোদন করান এবং ত্রুটি দূর করেন।’
দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি ঘুরে দেখা গেছে, ভবনের ছয় তলায় ছিল কার্টনের গোডাউন। পঞ্চম তলায় বিভিন্ন কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক মোড়কের গোডাউন। চতুর্থ এবং তৃতীয় তলায় উৎপাদিত হতো সেজান জুসের বিভিন্ন পণ্য। তবে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাশেই রাখা ছিল সারি সারি কার্টনভর্তি পণ্য। সঙ্গে অতি দাহ্য পদার্থের ছড়াছড়ি।
তৃতীয় তলায় ক্যান্ডি লাইন ও নসিলা উৎপাদনের প্লান্টের ফ্লোরে মজুদ ছিল যাবতীয় ফ্লেভার, সুগার ও গ্লুকোজের কার্টন, নানারকম কেমিক্যাল ও মোড়ক উৎপাদনের পলি। চতুর্থ তলায় লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর ঝালমুড়ি তৈরি হলেও এ তলার একপাশে ছিল গোডাউন, যেখানে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন ও ডালডার মজুদ ছিল।
নিচতলায় ছিল কার্টন, এলডিপি বা প্লাস্টিকের পলি উৎপাদন প্লান্ট। এখানে আরেকটি সাইটে প্রক্রিয়াজাত করা হতো ময়দা, ছিল কম্প্রেশার মেশিন। রাখা ছিল ফয়েল পেপারের বড় বড় রোল। আঁঠা জাতীয় কেমিক্যালের উপস্থিতিও এখানে পাওয়া গেছে। নিচতলায় ড্রিংকস, বিস্কুট উৎপাদন প্লান্ট হলেও এখানে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। দ্বিতীয় তলায় লিচুর জুস ও লাচ্ছি তৈরি হতো। তৈরি হতো এসব পণ্যের প্লাস্টিক বোতল। ছিল প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল রেজিনের মতো দাহ্য পদার্থ।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক তানহা জানান, সবকটি ফ্লোরেই সিঁড়ির সামনে লোহার তারের পার্টিশন দেয়া আছে। উৎপাদনরত অবস্থায় এসব ফ্লোরগুলোর পার্টিশন তালাবদ্ধ থাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় শ্রমিকরা উপরে যেতে পারেননি, নিচেও নামতে পারেননি বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির সভাপতি মো. মোশারফ হোসেন বলেন, কারখানাটি ছিল একটি মৃত্যুকূপ। আগুন লাগলে নিরাপদে বেরিয়ে আসার মতো ন্যূনতম পরিস্থিতি কারখানাটিতে ছিল না।