করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বেড়েছে।
মহামারির মধ্যে গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ৫ দশমিক ১ জন মারা গেছে। তার আগের বছরে (২০১৯ সাল) এই হার ছিল ৪ দশমিক ৯ জন। অর্থাৎ গত বছরে আগের বছরের তুলনায় মৃত্যুহার কিছুটা বেড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে ১১ জুলাই রোববার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হবে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা: প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে।’
নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশও বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মতো এবারও দিবসটি উপলক্ষে তেমন কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন সফলতা কামনা করে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর অনলাইনে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করেছে। এতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রধান অতিথি থাকবেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখ। দেশে বর্তমানে মোট পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার; আর নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার।
২৮ জুন প্রকাশিত বিবিএসের ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-তে এই তথ্য উঠে এসেছে। ওই তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের গড় আয়ু দুই মাস বেড়ে ৭২ বছর ৮ মাস হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭১ বছর ২ মাস; আর নারীদের ৭৪ বছর ৫ মাস।
এর আগের ২০১৯ সালের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৭২ বছর ৬ মাস।
২০২০ সালের হিসাবে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭২ দশমিক ৮ বছর, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৬ বছর।
দেশে গড় আয়ু ২০১৮ সালে ৭২ দশমিক ৩ বছর, ২০১৭ সালে ৭২ বছর এবং ২০১৬ সালে ৭১ দশমিক ৬ বছর ছিল।
প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি। ২০২০ সালে পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু হচ্ছে ৭১ দশমিক ২ বছর। ২০১৯ সালে ছিল ৭১ দশমিক ১ বছর। ২০১৮ সালে ৭০ দশমিক ৮ বছর, ২০১৭ সালে ৭০ দশমিক ৬ বছর এবং ২০১৬ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৩ বছর।
অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রত্যাশিত গড় আয়ু হচ্ছে ৭৪ দশমিক ৫ বছর, ৭৪ দশমিক ২ বছর, ৭৩ দশমিক ৮ বছর, ৭৩ দশমিক ৫ বছর এবং ৭২ দশমিক ৯ বছর।
বিবিএসের তথ্য বলছে, জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে ১ দশমিক ৩০ জন হয়েছে। আগের বছর এ হার ছিল ১ দশমিক ৩২ জন। এর ৫৪ শতাংশ পল্লী এলাকায় আর ৪৬ শতাংশ শহরে।
২০২০ সালে দেশে স্থূল জন্মহার ছিল (প্রতি হাজারে) ১৮ দশমিক ১ জন। আগের বছরও একই হার ছিল।
মহামারির মধ্যে গত বছর প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ৫ দশমিক ১ জন মারা গেছে। তার আগের বছরে এই হার ছিল ৪ দশমিক ৯ জন। অর্থাৎ গত বছরে আগের বছরের তুলনায় মৃত্যুহার কিছুটা বেড়েছে।
তবে শিশু মৃত্যুহার অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি হাজারে ২১টি শিশু মারা যাচ্ছে। আর মাতৃমৃত্যুতে আরও কিছুটা উন্নতি হয়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৬৩ জন হয়েছে। আগের বছরে এটা ছিল ১ দশমিক ৬৫ জন।
বিয়ের গড় বয়স ২৪ দশমিক ২ মাস অপরিবর্তিত রয়েছে। আগের বছরও একই হার ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। শহর এলাকায় ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার করে। অন্যদিকে গ্রামে ব্যবহার করে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ।
৭ বছর ও তদুর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার এখন ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করছে। আগের বছর পর্যন্ত এই হার ছিল ৯৮ দশমিক ১ শতাংশ। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার। আগের বছর পর্যন্ত এই হার ছিল ৯৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার।
এই সময় পর্যন্ত স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার। গত বছরও এই হার একই ছিল। দেশে এখন প্রতি হাজারে প্রতিবন্ধী রয়েছে ৮ দশমিক ৫ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৯ দশমিক ৩ জন, আর নারী ৭ দশমিক ৬ জন।
রাষ্ট্রপতির বাণী
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২১ উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। এ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অধিকার ও পছন্দই মূল কথা: প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে’, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও যথার্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য প্রত্যেক নর-নারীর অধিকার। নিরাপদ মাতৃত্ব ও প্রসূতি সেবা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা, নারীদের সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্তসহ নারীর যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। পরিকল্পিত পরিবার একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। পরিবারের আকার ছোট হলে তা পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার পূরণের পাশাপাশি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে পুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আশংকা রয়েছে। তাই এ সময় দেশে প্রজননস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি আরও জোরদার করতে হবে এবং চলমান কর্মসূচিগুলোতে উদ্ভাবনীমূলক কর্মকাণ্ডের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি আমি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আরো সক্রিয় ও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দারিদ্র্যের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সীমিত রেখে দারিদ্র্য বিমোচনসহ শিক্ষার হার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। মহামারির এ সময়ে অধিক সন্তানের জন্মরোধ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে সক্ষম দম্পতিদের নিকট পরিবার পরিকল্পনা সেবা সঠিক সময়ে পৌঁছে দেয়া অত্যন্ত জরুরি। দেশে বিদ্যমান সেবা অবকাঠামোসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং মানসম্মত প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে—এ প্রত্যাশা করি।’
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
দিবসটি উপলক্ষে বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১১ জুলাই রোববার বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২১ পালন করা হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, একটি দেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলে প্রতিটি সেক্টরে এর প্রভাব পড়বে। তাই একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিকল্পিত জনসংখ্যা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার পূরণের পাশাপাশি সুখী—সমৃদ্ধ দেশ গঠনে পরিকল্পিত জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
‘আমরা জনসংখ্যাবিষয়ক বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা, পরিকল্পিত পরিবার গঠন, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাভাবিক প্রসব সংক্রান্ত সব সেবা, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা এবং আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিগ্রহীতার হার বৃদ্ধিকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দিয়েছি। নিরাপদ মাতৃত্ব, কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য, নারী শিক্ষা ও নারী কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’
‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীগণ প্রতিমাসে প্রায় ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে দম্পতি পরিদর্শনের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা এবং পরামর্শ দিচ্ছেন। ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে এবং এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ অর্জন করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস অতিমারি মোকাবিলা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এ সময় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। অতিমারির সময় জন্মহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা সীমিত রাখতে হলে এ সময় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সরবরাহ যাতে সঠিক মাত্রায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
‘করোনাভাইরাস অতিমারিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০-এর লক্ষ্যসমূহ অর্জন করে ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নত-সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ সৃষ্টিই আমাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সুস্থ-সবল জাতি গঠনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুর প্রজনন-বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের সেবা অবকাঠামোসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সহযোগী সংগঠন, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আরও নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
বাণীতে দিবসটি উদযাপনে সকল কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জনসংখ্যা বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ১১ জুলাই উদযাপন করা হয় এই দিনটি৷ ধারণা করা হয়, ১৯৮৭ সালের এই দিনে বিশ্বের জনসংখ্যা পাঁচ বিলিয়নের ঘরে পৌঁছেছিল৷ ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি, ইউএনডিপি এই দিনটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালন শুরু করে৷