করোনাভাইরাস মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় ভোলার চরফ্যাশন থেকে ঢাকায় কাজ করতে এসেছিল ১২ বছরের হাসনাইন। দেড় মাস আগে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড বেভারেজ কোম্পানির কারখানায় মাসে আট হাজার টাকা বেতনে কাজ নেয় সে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভবনটিতে আগুন লাগ। এ ঘটনায় ৫২ জনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য মিলেছে। একটি বেসরকারি সংস্থা জানতে পেরেছে ৫১ জন নিখোঁজের তথ্য।
হাসনাইনের কী হয়েছে, জানেন না স্বজনরা। তার খোঁজে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের সামনে ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার খালা লাইজু। আকুতি জানাচ্ছিলেন ‘আর কিছু চাই না। কেবল আমাদের লাশটা চাই। লাশটা দেন।’
ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭৯৫ জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ২১৩ জন।
বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এগুলোর কারণ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে অবকাঠামোগত ত্রুটির দিকে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি দুর্ঘটনার মৃত্যুর সংখ্যা আরেকটি বড় কারণ শ্রমিকদের ভবন থেকে বের হতে না দেয়া।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরিন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০০ জনের বেশি শ্রমিক দগ্ধ হয়ে এবং ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, আগুন লাগার পরপরই কারখানার তৃতীয় তলার ফটকে তালা মেরে দেয়া হয়েছিল।
একই রকম অভিযোগ উঠেছে রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানার আগুনের ঘটনাতেও। শ্রমিকরা বলছেন, আগুন থেকে বাঁচার জন্য ভবনের ছাদে উঠতে গিয়ে সিঁড়ির গেটে তালা দেখেছেন তারা।
এছাড়া একটি ঘরে শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ করেছে কারখানার একজন শিশু শ্রমিকও।
ঘটনাস্থলে গবেষক মাহতাব উদ্দিনের কাছে বৃহস্পতিবারের ঘটনার বর্ণনা দেয় ফাতেমা।
পুড়ে যাওয়া সেজান জুসের কারখানাসে বলে, ‘আমি কিচ্ছু বলতে পারি না। আমি আমার বইনের খোঁজ নিছি। তারপরে শুনি, চাইরতলায় নাকি এসি রুমের ভিতরে তালা লাগায়া রাখছে। অনেক মানুষে বলছে তালাটা খোলো। তালা খোলে নাই। মালিকে নাকি কেডা নাকি অর্ডার দিছে তালা লাগায়া রাখতে।’
দুর্ঘটনার সময় শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করা নিয়ে শ্রমিক অধিকার নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেখানে কারখানা থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা সেটি ঠিক ছিল না। তারপর অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক ছিল না। যাদের এইগুলা দেখার দায়িত্ব তারা তা না দেখে মালিকদের সঙ্গে যোগসাজস করেছে। একই ঘটনা রানা প্লাজা ও তাজরিনেও ঘটেছে। অন্যান্য কারখানাতেও একই ঘটনা রয়েছে। কারখানাতে আগুন লাগার পর বের হওয়ার দরজা নেই। তবে আইন বলে সেখানে একাধিক দরজা থাকতে হবে এবং বাধাহীন হতে হবে।’
কারখানার ভেতর থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর নিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসপ্রতিটি ঘটনার পরে যে কথাগুলো সরকারি তরফ থেকে আসে, সেই একই ধারাবাহিকতা এবারও দেখা গেছে। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুনের ঘটনায় সরকারের কোনো সংস্থা বা মালিকপক্ষের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু আলোচিত বহু দুর্ঘটনার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ধরনের বক্তব্য এসেছে প্রতিবার। কিন্তু কারও সাজা হয়েছে, এমন ঘটনা বিরল। মামলা চলে বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে মামলাই করা যায়নি। আর বহু দুর্ঘটনায় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মালিকের আর্থিক ক্ষতি যেমন হয়েছে, তেমনি বহু শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে।
শেষ হয় না বিচার
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনার কোনো বিচার হয় না। এমনকি অনেক মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি জানে না সংশ্লিষ্ট থানাও।
২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হামিম গ্রুপের ১১ তলা ভবনে আগুন লাগে। এতে মারা যান ২৪ জন শ্রমিক। তবে ওই ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়েছিল কি না সেটি জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট থানা।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হামিম গ্রুপেও শ্রমিকরা বের হতে না পেরে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের মালিকপক্ষ এলাকা থেকেও তাড়িয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে কোন আওয়াজও করতে দেয় না কাউকে। আমার জানা মতে, এটা নিয়ে কোন মামলা বা কোন কিছুই করা হয়নি।’
২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশনে আগুনে ১১২ শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনায় করা মামলায় জামিনে মুক্ত আছেন কারখানা মালিক দেলোয়ার হোসেন। আর বেঁচে ফেরা অনেক শ্রমিক আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মামলা কবে নিষ্পত্তি হবে, এই বিষয়টি অজানা এখনও।
তাজরিন ফ্যাশনে আগুনের ঘটনায় মামলা হয় সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানায়। ওই মামলার খোঁজখবর জানতে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ জিয়াউল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে পুড়ে যাওয়া মরদেহ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনের ঘটনাটিও সে সময় তুমুল আলোচনা তৈরি করে। মারা যায় মোট ৪২ জন।
এর একটি মামলায় পুলিশ ও অন্যটিতে নিহত এক শ্রমিকের বাবা বাদী হন। পুলিশের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে প্রধান আসামি করে ১০ জনকে আসামি করা হয়।
ওই মামলার বাদী ছিলেন টঙ্গী থানার এসআই অজয় কুমার চক্রবর্তী। ওই মামলায় মকবুল হোসেন ছাড়াও কারখানার উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা আসামি হন।
২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের অপর মামলাটি করেন। ওই মামলায় টাম্পাকো মালিকসহ আট কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।
মামলা দুটির বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাসুদ বলেন, ‘২০১৮ সালে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠিত হয়। টাম্পাকোর মামলাগুলো ২০১৬ সালের। তাই ওই মামলার কোন তথ্য থানায় নেই।’
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ দক্ষিন) মোহাম্মদ ইলতুৎ মিশ জানান, ‘এই মুহূর্তে ওই মামলা সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। মামলার নথি খুঁজে পেলে জানানো যাবে।’
পুলিশের করা হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা তিন দফায় পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মালেক খসরু খান, পরে উপ-পরিদর্শক নিজাম উদ্দিন ও সবশেষ পুলিশ পরিদর্শক আলমগীর হোসেন মামলাটি তদন্ত করেন।
২০১৮ সালের ১২ মে আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ পরিদর্শক আলমগীর হোসেন। পরবর্তীতে একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সম্পুরক চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।
নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা কাদির পাটোয়ারির মামলাটিতে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু এরপর কী হয়েছে, সেটি আর জানে না বাহিনীটি।
আরও কয়েকটি আলোচিত দুর্ঘটনা
ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে শান নিটিংয়ে আগুনে নিহত হয় ২২ জন।
২০০৬ সালে আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল কারখানায়। আগুনে প্রাণ যায় ৬৫ জন শ্রমিকের।
২০১০ সালের ফেব্রুয়রি মাসে গাজীপুরে গরিব অ্যান্ড গরিব স্যুয়েটার কারখানায় আগুনে নিহত হয় ২১ জন, আহত হন অর্ধশতাধিক।
২০১২ সালের নভেম্বর মাসে পোশাক কারখানায় সবচেয়ে বড় আগুনের ঘটনা ঘটে আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনসে। এ ঘটনায় নিহত হন ১১২ জন। আহত হন বহু পোশাক শ্রমিক (যার তালিকা কারখানা কর্তৃপক্ষ দেয়নি)। বাংলাদেশে কারখানায় আগুন লেগে এরচেয়ে বেশি মানুষ কখনও মারা যায়নি।
২০১৩ সালের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে আগুনে নিহত হয় ১২ জন।
নিখোঁজদের মরদেহের সন্ধানে মর্গের সামনে ছবি হাতে স্বজনদের অপেক্ষা। ছবি: নিউজবাংলাএকই বছর মে মাসে রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় তুং হাই সুয়েটার কারখানায় আগুন লেগে মারা যায় ৭ জন। এদের একজন ছিলেন কারখানার মালিক। পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারও সেদিন মৃত্যু হয় সেখানে।
একই বছরের অক্টোবর মাসে গাজীপুরের শ্রীপুরে আসওয়াদ কম্পোজিটে পুড়ে মরে সাত জন শ্রমিক।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে মিরপুরের স্টাইরোফোম প্যাকেজ ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে নিহত হন ১৩ জন।
গত বছর জুলাই মাসে গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে ১৩ জন নিহত ও আহত হয় ৪৭ জন।
এছাড়া ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা যায় ২৭ জন। ১৯৯৫ সালে ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে নিহত হয় ১০ গার্মেন্টস কর্মী।
১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ এবং সানটেক্স লিমিটিডের কারখানায় আগুনে পুড়ে ১৪ জন শ্রমিক মারা যায়।
১৯৯৭ সালে রাজধানীর মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টসে ২৭ জন ও মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় নিহত হয় ২২ জন শ্রমিক।
২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে পুড়ে মৃত্যু হয় ৫৩ শ্রমিক। একই বছর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে মারা যায় ১২ জন।
২০০১ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবের ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় ২৪ গার্মেন্টস শ্রমিক। তারও এক সপ্তাহ আগে মিরপুরের কাফরুলে আরো ২৬ শ্রমিকের প্রাণহানি দেখে দেশ।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে নিহত হয় ৪৮ জন শ্রমিক।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এসব দুর্ঘটনার শিকারদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।