রূপগঞ্জে হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগার পর ভেতরে আটকা পড়াদের আর্তনাদ শুনেছেন রহিমা। তিনি থাকেন কারখানাটির এক শ গজের ভেতরে পারভিন ভিলা নামে একটি বাসায়।
রহিমা বলেন, ‘আগুন লাগায় সব ওয়ার্কার জানালার দিকে আইয়া দাঁড়ায়। জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দম নিতেছিল। ধোঁয়া আর আগুন বাড়া শুরু হইলে সবাই চিল্লান শুরু করে। ছোড ছোড বাচ্চাগুলান জানালার বাইরে হাত বাড়াইয়া ডাকতেছিল, তাদের নামাইয়া আনতে কইতেছিল।’
কারখানার শ্রমিকদের অনেকেই শিশু বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা ৪২ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়। নিচতলায় লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে ছয়তলা ভবনের পুরোটিতে। আগুনে দিশেহারা অনেকে তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় থাকা ২৫ জনের মতো শ্রমিক ভবনের ছাদের গেটের তালা ভেঙে ওপরে যান। তাদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
আগুনের ঘটনায় লাফিয়ে নিচে পড়ে আহত তিনজন ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর মারা যান।
এ ছাড়া চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যাদের কাউকেই চেনা যাচ্ছে না।
সিঁড়ির গেটে তালা দেয়া হয় আগুন লাগার পর
কারখানার চতুর্থ তলার এক জায়গা থেকেই ৪০টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকাজে থাকা কর্মীরা। কারখানার ভেতরে কোনো সমস্যা হলেই সিঁড়ির গেটগুলোতে তালা দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার কর্মীরা। গতকালও আগুন লাগার পর গেটে তালা দেয়া হয় বলে ভেতরে আটকে থাকা শ্রমিকরা ফোনে বাইরে থাকা স্বজনদের জানিয়েছেন।
কারখানা থেকে শ্রমিকদের মরদেহ বের করে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যালে
আগুন লাগে ভবনের নিচতলা থেকে। ফলে অন্য ফ্লোরের শ্রমিকরা ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছেন।
ভবনের চতুর্থ তলায় কাজ করতেন আছমা। রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কাজ ছিল তার।
আছমা বলেন, ‘আগুন লাগার পর চারতলায় সিঁড়ির গেটে তালা দিয়ে দিছিল। লোকজন উপরে যাইতে পারছিল না। সবাই দম নিতে জানালার দিকে আইছিল।’
কারখানার ভেতরে আটকে পড়া কর্মীরা তালা দেয়ার কথা মোবাইল ফোনে জানিয়েছিলেন বলে জানান আছমা।
স্মৃতিও দেখেছেন অসহায় শিশু কর্মীদের কান্না
হাশেম ফুডস লিমিটেডের কারখানাটিতে দুই শিফটে কাজ চলছিল। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নিচতলার নুডলস ও মেকারনি সেকশনে কাজ করছিলেন ১৩ বছর বয়সী স্মৃতি। বিকেলের দিকে অনেকে ছুটি চাওয়ায় স্মৃতি ও তার সেকশনে থাকা সবাইকে ৪টার দিকে ছুটি দেয়া হয়।
ছুটি পেয়ে কারখানার কাছেই বাসায় ফেরার পর ৫টা ৪২ মিনিটে চিৎকার শুনে বাসার বাইরে আসেন স্মৃতি। তাকিয়ে দেখেন ধোঁয়া। তার সমবয়সী কর্মীরা ভবনের জানালাগুলোর পাশে এসে সাহায্য চেয়ে কাঁদছিলেন।
শুক্রবার বিকেলে স্মৃতি তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কপালে মরণ ছিল না। ছুটি দেয়ায় বাইচ্চা গেছি।’
খাবারের কারখানাজুড়ে কেমিক্যাল আর প্লাস্টিক
প্লাস্টিক দানা, বোতল, কর্ক, পলিথিন, কার্টন, মবিল ও কেমিক্যাল ভর্তি ছিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হাশেম ফুডের কারখানাটি। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য থাকায় আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের বেগ পেতে হয়েছে।
পরিচয়পত্র তুলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেক স্বজন
শুক্রবার বিকেলে কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যালের ড্রাম, কনটেইনার ও প্লাস্টিকের বোতল।
কারখানাটিতে জুস, লাচ্ছি, সেমাইসহ বিভিন্ন পণ্য বোতলজাত ও প্যাকেজিং করা হতো। এসব পণ্যের গায়ে লেবেল লাগানো হতো, পলি করা হতো। প্যাকেট করা হতো কারখানার ভেতরে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস।
তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে আমরা কাজ করছি। এখন আগুন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আগুন এখনও পুরোপুরি নির্বাপণ হয়নি। নির্বাপণের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ভবনের চারটি ফ্লোর থেকে ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও ৩ জন হাসপাতালে নেয়ার পর মারা গেছেন।
কোন ফ্লোরে কী ছিল
ছয়তলা ভবনটিতে সজীব গ্রুপের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদন হতো।
কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিচতলায় বিভিন্ন পণ্যের কার্টন রাখা হতো। এক পাশে ছিল নুডলস ও মেকারনি তৈরির সেকশন। দ্বিতীয় তলায় টোস্ট, বিস্কুটসহ বিভিন্ন বেকারিপণ্য তৈরির কাজ চলত। তৃতীয় তলায় ছিল লাচ্ছা সেমাই ও বিভিন্ন জুস তৈরির মেশিন। চতুর্থ তলায় চকলেট, ললিপপ ও চকোচকোসহ আরও কয়েকটি খাদ্যপণ্য তৈরির মেশিন।
পঞ্চম তলায় চানাচুর ও ষষ্ঠ তলায় ছিল গুদাম। এ ছাড়া ছয়তলা ভবনের ছাদের একটি অংশে ছিল আরও একটি গুদাম।