মুজিব বর্ষে গৃহহীনদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা বেশ কিছু ঘরে ত্রুটি, ধস ও ফাটল ধরার ছবি গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঁচটি দল গঠন করে জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে।
কোথায়, কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, সেটি খতিয়ে দেখে সরকারপ্রধানকে প্রতিবেদন দেবে তারা।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে শুক্রবার মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় পৌঁছায় দুটি দল। তারা উপহারের বাড়িগুলো পরিদর্শন ও উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এ বি এম সরওয়ার-ই-আলম সরকারসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মাঠ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ সময় বাড়ি নির্মাণে অনিয়মের কথা জানতে পারে দল দুটি। আর এই বাড়ি নির্মাণে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
পরিদর্শক দলের প্রধান ও দেশজুড়ে বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমি যে তথ্য পেয়েছি, ওখানে ইটের সলিং দেয়ার কথা, সেটা তারা দেয়নি। ঢালাইটাও মানসম্মত না। সেটি পাওয়ার পর কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মেরামত শুরু করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ সদরে এ কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তারা সবাই ওএসডি হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাই মিলে কিন্তু কাজটা করছেন। এই করোনাকালীন ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি ঘর দেয়া, এটা কম কথা নয়। তাদের কাজকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু আমাদের মনটাই খারাপ হয় যখন আমরা দুই-চারটা সমস্যার কথা শুনি।’
তবে যেখানে অনিয়ম হয়েছে, সেই গজারিয়ার বালুয়াকান্দি ও সদর উপজেলার সিলই ইউনিয়নে যায়নি দল দুটি।
বালুয়াকান্দিতে নদীর তীরে মাটি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরগুলো। মাটি সরে ধসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সেগুলো। এরই মধ্যে কয়েকটি পিলার ভেঙে গেছে।
সিলই ইউনিয়নের ৫০টি ঘরের মেঝে ফেটে গেছে এরই মধ্যে। ঘরগুলো যত উচ্চতায় নির্মাণের কথা ছিল, ততটা হয়নি।
গৃহহীনদের ঘর: উচ্ছ্বাস পরিণত হয়েছে ক্ষোভে
দেশে একজনও গৃহহীন থাকবে না, এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মানসম্পন্ন ঘর নির্মাণ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পর প্রশংসিত হয়েছে।
প্রথম দফায় ২৩ জানুয়ারি ৬৬ হাজার গৃহহীন পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় আরও ৫৩ হাজার ৩৪০ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে দেয়া হয় ঘর।
প্রথম পর্বে ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সে সময় বেশ কিছু এলাকায় ঘর নির্মাণে ত্রুটির সংবাদ আসার পর স্থানীয় প্রশাসনের দাবির মুখে দ্বিতীয় পর্বে ঘর নির্মাণে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা।
তবে প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বের ঘরগুলোতে অনিয়মের তথ্য আসছে বেশি।
নির্মাণের সময়েই ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিক এলাকায়। কোথাও কোথাও পিলার ভেঙে গেছে, কোথাও কোথাও দেয়ালে বিশাল ফাটল ধরেছে, কোথাও কোথাও মাটি ধসে গেছে বৃষ্টিতে। পলেস্তরা খসে পড়ার কথা বলছেন উপকারভোগীরা।
এই ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়ার সময় মানুষ আপ্লুত হয়েছে, গৃহহীনরা তাদের সারা জীবনের আশ্রয়হীনতার দুঃখ ভুলে কিছুটা হলেও স্বাচ্ছন্দ্যে বাকি জীবন পার করার স্বপ্ন দেখার কথা জানিয়েছেন। তবে এসব ঘরের অনেকগুলোর করুণ চিত্রে মানুষ আবার ক্ষুব্ধ হয়েছেন আর সেটি সামাজিক মাধ্যমে তারা প্রকাশও করছেন।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তৎপর হয়ে ঘরগুলো পরিদর্শনে কমিটি গঠন করে। এই প্রকল্প সরকারপ্রধানের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল। বিতর্ক এড়াতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিকদের না জড়িয়ে কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের। কিন্তু একাধিক এলাকায় নানা অজুহাতে উপকারভোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় এমনকি ঘর বিক্রি করে দেয়ার খবরও এসেছে।
এরই মধ্যে একাধিক ইউএনওর বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত পাঁচজন ইউএনওকে প্রত্যাহার করে ওএসডি করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুক্রবার সকালে একযোগে পাঁচটি দল সারা দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে রওনা দেয়।
প্রথম দফায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাকে পাঁচটি ব্লকে ভাগ করে যাচাই-বাছাই কাজ শুরু করবে এসব দল।
কোন দল যাবে কোথায়
মুন্সিগঞ্জ যাওয়া দুটি দল এই জেলা থেকে আলাদা হয়ে যাবে বিভিন্ন জেলায়।
মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এবং বগুড়ার সদর, শেরপুর ও শাহজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত ও নির্মাণাধীন বাড়িগুলো দেখতে যাবে।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমানের নেতৃত্বে অপর দল যাবে হবিগঞ্জ সদর, মৌলভীবাজার সদর ও সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায়।
বাকি তিনটি দলের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি দল ময়মনসিংহ ও জামালপুর; উপ-প্রকল্প প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল নীলফামারী ও লালমনিরহাট আর সহকারী প্রকল্প পরিচালক বদরুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল পাবনা, মানিকগঞ্জ, নাটোরের বিভিন্ন এলাকার বাড়ি সরেজমিনে পরিদর্শনে গেছে।
মুন্সিগঞ্জে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি ঘুরে মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে থেকে দলগুলোর পরিদর্শন শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব জেলায় যাবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় এ কথাগুলো (অনিয়মের অভিযোগ) উঠছে যে এ কথাগুলো সঠিক কি না। সেটা যাচাইয়ের জন্য কমিটি করে তদন্ত করতে বলি।’
কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প, স্বপ্নের প্রকল্প। একটা গরিব লোক যিনি ঘর পাচ্ছেন, এটা তার একটা স্বপ্নের সূচনা হয়। কাজেই এটা নিয়ে আমরা কোনো অবহেলা করব না এবং কোনো অবহেলা সহ্য করব না।’
বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নির্মিত এবং নির্মাণাধীন বাড়িগুলোর নির্মাণশৈলী ও গুণগত মান, অনুমোদিত ডিজাইন ও প্রাক্কলন অনুযায়ী হয়েছে কি না, তা যাচাই করা এবং ছবিসহ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কী আছে প্রকল্পে
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’ বাস্তবায়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০টি পরিবারকে ২ শতাংশ খাসজমিসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট আধা পাকা বাড়ি দেয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার এবং জমি আছে ঘর নেই অথবা অত্যন্ত জরাজীর্ণ ঘর- এ রকম ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে বাড়ি নির্মাণ করে দেবে সরকার।