দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আট জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ‘নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড’ (নেসকো)। প্রায় ১৬ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া নেসকো এরই মধ্যে ৫ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ করছে।
এখন আরও ১২ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। করোনা মহামারিতেই নতুন প্রকল্পে ২০ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে নেসকো।
স্মার্ট মিটার বসাতে দেশিয় অর্থে প্রায় সোয়া সাত শ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের পাঠিয়েছে কোম্পানিটি। এ নিয়ে জুনের শেষ দিকে মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। পিইসি সভায় বিদেশ সফরের প্রস্তাবে বাধ সেঁধেছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প শক্তি বিভাগের সদস্য শরিফা খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নিদের্শনায় করোনাকালীন বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রকল্পে বিদেশ সফর অনুমোদন দিচ্ছি না। তবুও বিভিন্ন প্রকল্পে প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব এলেও আমরা তা বাদ দিয়ে দিচ্ছি। এ প্রকল্পেও বিদেশসফর বাদ ও পরামর্শক খাতে ব্যয় কমানোসহ নানা বিষয় দেখা হয়েছে।’
প্রস্তাবিত নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড এলাকায় ১২ লাখ স্মার্ট প্রিপেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্পে মোট প্রাক্কালিত ব্যয় ৭২৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সময় ধরা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ১১ লাখ ১৩ লাখ ৬০৮টি সিঙ্গেল ফেজ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ক্রয় ও স্থাপন করা, ৮৬ হাজার ৩৯২টি থ্রি ফেজ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার ক্রয় ও স্থাপন করা, ১৩ হাজার ৬১৯টি ডাটা কনসেন্ট্রটর ইউনিট (ডিসিইউ) ক্রয় ও স্থাপন, ৩টি হেড ইন সিস্টেম (এইচইএস) স্থাপন করা হবে।
বিভিন্ন ব্যয়ের খাতের মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে সিঙ্গেল মিটার কেনায় ৩৯২ কোটি টাকা, একটি জিপ ও দুইটি পিকআপসহ গাড়ি কেনা যানবাহনে পেছনে প্রায় চার কোটি টাকা, ২০ কর্মকর্তার বিদেশ ও অন্যদের দেশে প্রশিক্ষণ খাতে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা।
নেসকো বলছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিল ব্যবস্থা সহজ ও অগ্রিম রাজস্ব আদায় হবে। কমবে সিস্টেম লস, বাড়বে গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী মনোভাব। এছাড়া লোড ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। এতে গ্রাহক সেবার মান বাড়বে।পরিকল্পনা কমিশনের মতামত
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ প্রকল্পের প্রস্তাবে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে।
কোনো সংস্থা দিয়ে না করিয়ে শুধু একজন প্রফেসর দিয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করিয়েছে নেসকো। তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন নি। তাছাড়া অন্য সংস্থার চলমান একই ধরনের অন্য কোনো প্রকল্পের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনাও নেই।
এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হলেও ২০ কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাখা হয়েছে দেশে প্রশিক্ষণও। এ দুই খাতে রাখা হয়েছে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ দুই খাতের ব্যয় আলাদা করে তা থেকে বিদেশি প্রশিক্ষণ বাদ দিতে হবে।
প্রকল্পে যানবাহন ক্রয়ের পরিমাণ ও মোট ব্যয় বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। এ খাতে ব্যয় কমাতে হবে। এ ছাড়া কি পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে? সিস্টেম লস কি পরিমাণ কমবে? লোড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও বিলিং ব্যবস্থা কতটা সহজ হবে তার উল্লেখ নেই।
নেসকোর আওতাধীন এলাকায় ৫ লাখ প্রিপেমেন্ট মিটার স্থাপনের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে ওই প্রকল্পের ওপর আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নতুন প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। যেসব প্রিডেইড মিটার কেনা হবে সেগুলোর ইকোনমিক লাইফ টাইম কতো বছর হবে তাও প্রস্তাবনায় উল্লেখ নেই।
প্রকল্পের আওতায় কাজ
নতুন প্রকল্পের প্রস্তাবনায় নেসকোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উত্তরের ১৬ জেলার ৩৯টি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এলাকার বাইরের গ্রাহকদের নিয়ে কাজ করে নেসকা।
বর্তমানে নেসকোর ১৬ লাখ ৩০ হাজার গ্রাহক রয়েছে। বিদ্যমান পোস্ট পেইড মিটারিং ব্যবস্থায় নন-টেকনিক্যাল সিস্টেম লস তুলনামূলক বেশি। এছাড়া পোস্ট পেইড মিটারে বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহে কয়েকমাস সময় লাগে। এতে অনেক সরকারি-আধাসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিল বকেয়া থাকে। যা আদায় করা অনেক কষ্টসাধ্য।
নেসকোর ৫৫টি বিরতণ ইউনিটের মধ্যে যেখানে সিস্টেমলস বেশি, স্মার্ট প্রি পেইড মিটারের মাধ্যমে সেগুলোতে লস কমিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে বকেয়া বিলের ঝামেলাও অনেক কমবে।
এ ছাড়া কিছু গ্রাহক মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত লোডের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। নতুন প্রিপেইড মিটারিংয়ে গ্রাহক তার বরাদ্দের অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করলে মিটার টেম্পারিংয়ের সংকেত দেবে। একই সময় লোড বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এতে লোড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ট্রান্সফরমারের লোড কমিয়ে আনা যাবে।
বর্তমান প্রকল্পের অবস্থা
২০১৮ সালের জুলাইয়ে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড এলাকায় পাচঁ লাখ স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। নানা জটিলতায় তখন কাজ শুরুই হয়নি, পরে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। যা শেষ হবে ২০২২ সালের জুনে।গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ছিল ২৫ শতাংশ, বাস্তব অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকার মতো।
নেসকো সূত্র জানিয়েছে, চলমান প্রকল্পে স্মার্ট প্রি পেমেন্ট মিটার বসানো হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে স্থাপন করা হবে এক লাখ ৪০ হাজার স্মার্ট মিটার। এরপর বাকি দুই ধাপে বাকি গ্রাহকদের কাছে স্মার্ট মিটার পৌঁছে দেয়া হবে। ২০২২ সালের মধ্যেই সংস্থাটি কাজ শেষ করতে পারবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুল আলম চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলমান প্রকল্পটি অগামী বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ আছে। করোনার কারণে প্রকল্পের কাজে কিছুটা দেরি হয়েছে। এরই মধ্যে মিটার কেনার শেষ হয়েছে। প্রায় এক লাখের বেশি মিটার বসানোও শেষ হয়েছে। সদ্য শেষ অর্থ বছরেও প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৯৫ ভাগ। তবে আর বাড়তি সময় লাগবে না। নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে।’