বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রুয়েটের কোটি টাকার গবেষণার ফল শূন্য

  •    
  • ৬ জুলাই, ২০২১ ১৯:৩৭

‘ইন্ডাস্ট্রি যদি আগ্রহী হয়, তারা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে তাড়াতাড়ি এগুলো বাস্তবমুখী করা যাবে। তাদের সঙ্গে মিলে এগুলোর সফল রূপ দেয়া সম্ভব। এগুলো হলে যারা বানাচ্ছে তাদের, প্রতিষ্ঠানের, আমাদের দেশের—সবার সুনাম হবে। এগুলো হলে প্রযুক্তি আর বিদেশ থেকে আনতে হবে না। তবে এ জন্য ইন্ডাস্ট্রির দরকার।’

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাকাজ ও উদ্ভাবনগুলো প্রায়ই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়। কার্যকারিতার কারণে এগুলোর প্রশংসাও কম জোটে না। তবে বাস্তবে এগুলো কোনো কাজেই আসছে না।

বিভিন্ন সময়ে এখানকার গবেষকরা নতুন নতুন উদ্ভাবন করে চলেছেন। এর পেছনে ব্যয়ও হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু এসব উদ্ভাবন বাস্তবে কোনো কাজে আসছে না। এগুলো থেকে প্রাপ্তি শুধু সংবাদমাধ্যম বা জার্নালে প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

গবেষকরা বলছেন, তাদের গবেষণা কাজগুলো বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রির। এর কোনো সুযোগ নেই। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এ নিয়ে চেষ্টা করছে।

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রোগীদের চিকিৎসার জন্য সংকট দেখা দেয় ভেন্টিলেটরের। সেই সময়ই কম খরচে চালানোর মতো একটি ভেন্টিলেটর তৈরি করেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীদের ‘দুর্বার কান্ডারি’ নামের একটি গবেষকদল। সেটি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারও করা হয়। তবে আর এগোয়নি। এখন এটি পড়ে আছে এক গবেষকের বাড়িতে।

শিক্ষার্থীদের তৈরি ভেন্টিলেটর। ছবি: নিউজবাংলা

প্রায় একই সময় আরেকটি গবেষকদল ‘ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম’ নামে একটি বিশেষ রোবট উদ্ভাবন করে। কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসক ছাড়াই করোনার নমুনা সংগ্রহ, রোগীর শরীরের তাপমাত্রা মাপা, ওষুধ দেয়া এমনকি ভিডিও কনফারেন্সে চিকিৎসক দেখানোর কাজটি করতে সক্ষম এই রোবট।

এই উদ্ভাবন অনেকের মধ্যেই সাড়া ফেলে। বিশেষ করে করোনা রোগীর কাছে না গিয়েও তার চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে এমন একটি রোবট বিশেষ কার্যকর বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এটিও আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কোনো কাজেই আসেনি এই উদ্ভাবন। এটিও এখন পড়ে আছে এক গবেষকের বাড়িতে।

২০১৯ সালে কম খরচে পরিবেশবান্ধব একটি গাড়ি তৈরি করে প্রশংসিত হন রুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এটির নাম দেয়া হয় ‘হাইব্রিড কার’। এটিও আলোর মুখ দেখেনি। কোনো অগ্রগতি নেই। পড়েই আছে।

হাইব্রিড কার। ছবি: নিউজবাংলা

প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য রুয়েটের গবেষকরা একটি বিশেষ ধরনের হুইলচেয়ার উদ্ভাবন করেন গত বছর। মানুষের কথার মাধ্যমে দিক পরিবর্তন ও চলাচল করতে সক্ষম এটি। হুইলচেয়ারটি তার বাহকের কণ্ঠ ও আদেশের মাধ্যমে চলে। তবে এটিও অন্য সব প্রজেক্টের মতোই পড়ে আছে। রুয়েটের উদ্ভাবনগুলো এভাবেই নষ্ট হচ্ছে। একদিকে দীর্ঘ সময়ের গবেষণা, অন্যদিকে আর্থিক বিনিয়োগ কোনোটাই কাজে আসছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে নানান উদ্ভাবন। এসব উদ্ভাবনের জন্য করা হচ্ছে কোটি টাকার গবেষণা প্রকল্প। গবেষণার জন্য খোলা হয়েছে একটি আলাদা বিভাগও। তবে সেই গবেষণার ফল শুধু জার্নালে প্রকাশ ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না।

গবেষণার জন্য তৈরি করা প্রজেক্টগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে কোটি টাকার প্রকল্প শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে। এর পর থেকে প্রতিবছরই গবেষণার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দেয় বিভাগটি।

গত চার অর্থবছরের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এ সময়ে ৮১টি প্রকল্পে ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৫ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গবেষণার জন্য ১৪টি প্রকল্পে ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫০ টাকা দেয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১টি গবেষণা প্রকল্পে ১ কোটি ২৫ লাখ ৯ হাজার ২৭০ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫টি প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৯৯ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩১টি প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৩৯ লাখ ২৯ হাজার ৮০৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষকদল বিভিন্ন সময়ে চমৎকার সব উদ্ভাবন করে প্রশংসিত হন। তবে এসব উদ্ভাবনের বাস্তব প্রয়োগ নেই। একটি সূত্র বা মডেল তৈরি করেই তারা কাজ শেষ করেন। সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগের কোনো ব্যবস্থা হয় না।

ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল ভেন্টিলেটর ও স্প্রেড হুইলচেয়ারের গবেষক প্রফেসর ড. মাসুদ রানা বলেন, আমাদের ভেন্টিলেটর প্রজেক্টের জন্য ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল। আর হুইলচেয়ারের প্রজেক্টের জন্য দেয়া হয় ৬ লাখ টাকা। আমরা এগুলো সফলভাবেই সম্পন্ন করেছি।

তিনি বলেন, ‘ভেন্টিলেটরটি উদ্ভাবনের পর এটি রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাদের দাবি ছিল, এটির আরও আধুনিকায়ন করার। তবে আমাদের প্রজেক্টের অন্য ৬ জন বিভিন্ন জায়গাতে চাকরিতে চলে যাওয়ার কারণে এটি আর করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, লকডাউন শেষ হলে আর ক্যাম্পাস খুললে এটি আবারও আপডেট করা হবে। এ ছাড়া আমাদের হুইলচেয়ারটির কোনো সমস্যা এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘রুয়েটে এখন গবেষণা মানের দিক থেকে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আমরা কষ্ট করে গবেষণা করে একটি কাঠামো উদ্ভাবন করি। তবে আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা এগুলোকে উৎপাদন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি না। কারণ আমাদের সঙ্গে কোনো কোম্পানির লিংক বিশ্ববিদ্যালয় করে দেয় না। ফলে, এগুলো পড়ে থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি কোম্পানির সঙ্গে লিংক করে দিত তবে এগুলো নিয়ে উৎপাদন করতে পারতাম। পাশাপাশি এগুলো মানুষের উপকারেও আসত।‘

হাইব্রিড কারের উদ্ভাবক প্রফেসর ড. ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমার গাড়িটি আরও অধুনিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এর জন্য অর্থ প্রয়োজন। সেটি নেই। একটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সেখানে কোনো অগ্রগতি নেই।’

‘এভাবেই অনেক প্রজেক্টই নষ্ট হচ্ছে। আমাদের রুয়েট কর্তৃপক্ষ কোনো কোম্পানির সঙ্গে লিংক করে না দেয়ার কারণেই এসব উদ্ভাবন শুধু প্রদর্শনীতেই শেষ হচ্ছে। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে আরও অর্থ ও কোম্পানির সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী গবেষণা করতে হবে। তাহলে এগুলো আলোর মুখ দেখবে।’

ক্যাপ্টেন সিতারার উদ্ভাবক দলের সদস্য শাহিদা আফরিন বলেন, ‘আমরা এটি নিজস্ব অর্থায়নে করেছি। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু কাজ করলেই হবে না। এগুলোর বাণিজিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রুয়েট কর্তৃপক্ষ যদি কোনো কোম্পানির সঙ্গে লিংক করে দেয় তাহলেই এগুলোর বাজারজাত করা সহজ হয়।’

এ বিষয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ড. ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাজগুলো চলছে। প্রতিবছরই এখানে অনেকগুলো প্রজেক্ট দেয়া হচ্ছে। এগুলো উৎপাদনের জন্য রাজশাহীতে ইন্ডাস্ট্রি না থাকায় বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া এগুলো আমাদের দায়িত্ব না। বাজারজাত করতে হলে নিজেদের করতে হবে। এই বিভাগের কিছু করার নেই। তবে আমরা এরপর থেকে ভালো উদ্ভাবন হলে কোম্পানিগুলোকে অফারের জন্য প্রশাসনকে জানাব।’

এ বিষয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘আমাদের এখানে যেসব গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে ভেন্টিলেটর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে এটি সরকারি পর্যায়ে যদি নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। আমরা হাসপাতালে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কোনো সাড়া পাইনি।’

‘আমাদের অনেক গবেষণাই হয়েছে। অনেক কার্যকর, জরুরি জিনিস বানিয়েছি। প্রথম দিকে হয়তো একটু সমস্যা হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এগুলো নিয়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যৌথভাবে করতে পারি। এগুলো করতে হলে অনেক টাকার বাজেটের প্রয়োজন। আমাদের সরকার বাজেট দিচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি যদি আগ্রহী হয়, তারা যদি এগিয়ে আসে তাহলে তাড়াতাড়ি এগুলো বাস্তবমুখী করা যাবে। তাদের সঙ্গে মিলে এগুলোর সফল রূপ দেয়া সম্ভব। এগুলো হলে যারা বানাচ্ছে তাদের, প্রতিষ্ঠানের, আমাদের দেশের—সবার সুনাম হবে। এগুলো হলে প্রযুক্তি আর বিদেশ থেকে আনতে হবে না। তবে এ জন্য ইন্ডাস্ট্রির দরকার।’

এ বিভাগের আরো খবর