গত ডিসেম্বরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুত সাবুসোলুর ঢাকা সফরের প্রধান লক্ষ্যই ছিল অস্ত্র বিক্রি। সে সময় আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হলো, সে বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই মেলেনি বক্তব্য। তবে ছয় মাস যেতে না-যেতেই দুই পক্ষে হলো চুক্তি।
২৯ জুনের এই চুক্তির পর বিবৃতিতে বলা হয়, অস্ত্র আসবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
তবে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আর তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য থেকে বাংলাদেশ কোন ধরনের অস্ত্র আনবে, সে বিষয়ে কিছু আভাস পাওয়া যায়।
তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুসদ মান্নান গত ফেব্রুয়ারিতে তুর্কি সংবাদমাধ্যম আনাদুলু এজেন্সিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশটি থেকে ড্রোন প্রযুক্তি আমদানিতে ঢাকার আগ্রহের কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘তুরস্কের ড্রোন বিশ্বমানের। প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ভবিষ্যতে আধুনিক সরঞ্জাম নেয়ার বিষয় বিবেচনা করতে পারি।’
সেনা প্রশিক্ষণেও বাংলাদেশের আগ্রহ আছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘তুরস্কের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা লাভবান হবেন।’
বাংলাদেশ চীন, ইতালি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সার্বিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিতে উৎপাদিত অস্ত্র ব্যবহার করে। সুইডেনভিত্তিক সিপরির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ তুরস্কের কাছ থেকে বড় রেঞ্জের মিসাইল কিনছে।
গত ডিসেম্বরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে অস্ত্র কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়
টিআরজি থ্রি জিরো জিরো নামের মিসাইল সিস্টেমটি জুনের ২১ তারিখে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয় বলে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে।
২০১৯ সালেও বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীও মিসাইল সিস্টেম কিনেছে দেশটি থেকে।
ডিফেন্সিয়া ডট নামে সামরিক একটি ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ তুরস্কের কাছ থেকে এয়ারক্রাফট, এরিয়াল ভেহিক্যাল, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, আর্মার্ড ভেহিক্যাল, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, আর্টিলারি সিস্টেম, ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারকেয়ার সিস্টেম, রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম ক্রয়ের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশের তৈরি অস্ত্র মানসম্পন্ন এবং দামে কম। বাংলাদেশ এই অস্ত্র কিনে লাভবান হতে পারে। তিনি বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির পাশাপাশি সামরিক খাতে বাংলাদেশকে যৌথ বিনিয়োগেরও প্রস্তাব দেন।
সেদিন বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা চায় জানিয়ে তুর্কি মন্ত্রী বলেন, ‘তুরস্কের যুদ্ধাস্ত্র বিশ্বের অন্যতম সেরা, দাম কম, কোনো আগাম শর্ত নেই। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে লাভবান হবে।’
তুরস্ক যেসব অস্ত্র রপ্তানি করে তার মধ্যে এই সাঁজোয়া গানটি অন্যতম
এর পরই দেশটিতে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মুসদ মান্নান তুরস্ক থেকে উচ্চপ্রযুক্তির ড্রোনসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কিনতে ঢাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এরই মধ্যে গত ২৯ জুন আঙ্কারায় তুরস্কের সঙ্গে ‘উল্লেখযোগ্য’পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’পূরণের অংশ হিসেবে গত ২৯ জুন আঙ্কারায় এ চুক্তি হয়।
অনুষ্ঠানে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুসদ মান্নান ও ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশেদ ইকবালসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
তুরস্কের অস্ত্রের ক্রেতা তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আবর আমিরাত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। এ ছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, তিউনিসিয়াও।
তবে দেশটির অস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাজার তুর্কমেনিস্তান ও আজারবাইজান। এর পরই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার তুরস্ক থেকে বেশি অস্ত্র কিনে থাকে।
এই অস্ত্র কেনার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যদি কোনো সিঙ্গেল কান্ট্রি থেকে অস্ত্র কিনি, তাহলে যেকোনো সময়ই এতে বিপদ হতে পারে। একটা সোর্স থেকে কিনলে যেকোনো সময় যদি ওই সোর্স অসহযোগিতা করে, তাহলে বিপদে পড়তে হয়। অনেক সোর্স থেকে তা কিনলে একটি সোর্স বন্ধ হয়ে গেলেও অন্য সোর্স থেকে তা পাওয়ার সুযোগ থাকে। এ জন্য আমরা বিভিন্ন সোর্স তৈরি করছি। আমি বলব, এটা আমাদের দেশের জন্য ভালোই।’
তিনি মনে করেন, তুরস্কের অস্ত্র বাংলাদেশকে বলিয়ান করবে, বিশেষ করে মিয়ানমারের চাপ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, ‘তুরস্ক থেকে সম্প্রতি যে অস্ত্র আমাদের দেশে এসেছে, তার একটি হাইরেঞ্জের (দূরপাল্লার) রকেট লঞ্চার, যার রেঞ্জ সম্ভবত ১২০ মাইল, যা কখনোই আমাদের কাছে ছিল না। রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পরে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। সে জন্য অস্ত্র কেনার সময় এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সেনাবাহিনী তাদের অস্ত্র কিনবে। যাতে মিয়ানমারের কাছে যে অস্ত্র আছে, আমাদের অস্ত্র যেন কমপক্ষে তাদের সমান মানের বা ছাড়িয়ে যায়।’
আরেক সামরিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলি শিকদার বলেন, ‘তুরস্ক থেকে এই প্রথম আর্মস কেনা হচ্ছে, তা কিন্তু না। আশির দশকে আমরা যখন সেনাবাহিনীতে ছিলাম, তখনও কিন্তু তা কেনা হয়েছে, বিশেষ করে ভারী অস্ত্র; যাকে আমরা আর্টিলারি গান বলি। আমরা তা ব্যবহারও করেছি।
‘তুরস্ক কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশ। তারা ইউরোপের অংশ। তাদের অস্ত্রের টেকনোলজির উৎস হলো ইউরোপ। অস্ত্রের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ব্যবহারের ওপর। তারা অস্ত্র উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী উল্লেযোগ্য ও পরীক্ষিত।’
আবদুর রশীদের মতো তিনিও একাধিক দেশ থেকে অস্ত্র আনার পক্ষে। বলেন, ‘আমাদের অস্ত্রের সোর্সের ডাইভারসিফিকেশন থাকতে হবে। আমরা চায়নার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। তুরস্ক থেকে যে অস্ত্র আসছে, তা আমাদের জন্য বড় ধরনের সুযোগ। তুরস্ক নতুন সোর্স হিসেবে আমাদের জন্য ভালোই হবে।’
তুরস্ক কী সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করে
গত এক দশকে তুরস্কের সামরিক শিল্প অনেকটাই এগিয়েছে। ২০২৩ সাল নাগাদ সামরিক খাত থেকে ২৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
দেশটি রস্ক ড্রোন, রকেট লাঞ্চার, স্বল্প পাল্লার মিসাইল, সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার, ট্যাংক ইত্যাদি উৎপাদন করছে। তাদের টি-ওয়ান টু নাইন হেলিকপ্টার একসঙ্গে আটটি অ্যান্টিট্যাংক মিসাইল, ১২টি নিয়ন্ত্রিত নিক্ষেপণযোগ্য রকেট ও অটোমেটিক গানের জন্য ৫০০টি গুলি বহন করতে পারে।
এই হেলিকপ্টার প্রচণ্ড গরম ও ঠাণ্ডায় বিরূপ পরিবেশে রাতের আঁধার বা দিনের আলোতে ভূমি থেকে অনেক উচ্চতায় অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম বলে গত ডিসেম্বরে ‘বিবিসি বাংলা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। টি-ওয়ান ফাইভ ফাইভ ফিরটিনা মিসাইল ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে। তুরস্ক মূলত সামরিক ড্রোন, রকেট লঞ্চার, মিসাইল, হেলিকপ্টার, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ ও ট্যাংক বিক্রি করতে চাইছে।
কতটা কার্যকর তুর্কি সামরিক সরঞ্জাম
‘বিবিসি বাংলা’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি তুর্কি সমরাস্ত্রের বড় ধরনের ব্যবহার হয়েছে সিরিয়া ও নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে। তুরস্ক সিরিয়ার যুদ্ধে অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চে কুর্দিদের বিরুদ্ধে নিজস্ব সমরাস্ত্র ব্যবহার করে সফল হয়েছে। নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে আজারবাইজান তুরস্কের সরবরাহ করা ড্রোন ব্যবহার করে ফরাসি সহায়তাপুষ্ট আর্মেনিয়াকে পরাজিত করেছে।
তুরস্কে একটি অস্ত্র প্রদর্শনীর চিত্র
তুরস্কের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত কিরিক্কিল প্রদেশে গড়ে উঠেছে তুর্কি সামরিক শিল্প। এখানে আছে মেকানিক্যাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন বা এমকেইকে। এই করপোরেশন বেশ কয়টি অস্ত্র কারখানা পরিচালনা করে। এই নগরীতেই ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তুরস্কের প্রথম বিশেষায়িত বাণিজ্যিক এলাকা ওআইজেড, যেখানে কেবল অস্ত্র কারখানাই থাকবে।
১৯৮০-এর দশকে বেশ কয়েকটি ন্যাটো সদস্যদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেরাই সমরাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। তুরস্ক তার একটি। প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে তারা দেশেই প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে।
২০০৩ সালে একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর এই খাতে আরো বেশি গুরুত্ব দেয় দেশটি। শুরুতে সাঁজোয়া যান দিয়ে শুরু করলেও এখন ট্যাংক, মিসাইল, রকেট লঞ্চার, ড্রোন সবকিছুই তৈরি হচ্ছে তুরস্কের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে।
স্থলযুদ্ধের বিভিন্ন উপকরণ নির্মাণ দিয়ে শুরুর পর যুদ্ধজাহাজ, অ্যাটাক হেলিকপ্টার এমনকি সর্বাধুনিক ফাইটার জেটও নির্মাণ করছে তারা। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের বিভিন্ন প্রযুক্তিও উৎপাদন করছে দেশটি। ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে দেশটির দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে টর্পেডো উৎপাদনের ঘোষণাও দিয়েছে। হেলিকপ্টার ড্রোন, মনুষ্যবিহীন নৌযানেরও সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। বর্তমানে তারা মনোযোগ দিয়েছে মনুষ্যবিহীন সাঁজোয়া যান, আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যান্ড টানেল ওয়ারফেয়ার উইপন্স এবং ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনে।