বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কিশোরীকে বিয়ে: সেই চেয়ারম্যান বরখাস্ত

  •    
  • ২৮ জুন, ২০২১ ২১:৩৩

কনকদিয়া ইউনিয়নের নারায়ণপাশা গ্রামের এক যুবক ও স্থানীয় মসজিদের ইমামের সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি স্থানীয় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি পরিবার। এর মধ্যে দুজন তিন দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। পরে সালিশ করতে ডেকে সেই মেয়েকে নিজেই বিয়ে করেন চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদার।

কিশোরীকে বিয়ে করায় পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ৬ নম্বর কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহীন হাওলাদারকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

সোমবার রাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ৬ নম্বর কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শাহিন হাওলাদার সালিশ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৪ বছর ২ মাস ১৪ দিন) কিশোরীকে বিয়ে করায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (৪) (ঘ) ধারার অপরাধ সংঘটিত করায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

কেন তাকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে না, চিঠি পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তার জবাব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতেও বলা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আ‌মি আপনা‌দের মি‌ডিয়াম্যান‌দের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তবে কোনো চি‌ঠি পাই নাই।’

জানতে চাইলে বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আ‌মি কোনো চি‌ঠি পাই নাই। টি‌ভিতে দেখছি। তবে আ‌মি বু‌জি না যে, কেন আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হবার মতো কোন কাম ক‌রি নাই। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’

১৪ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেও তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দাবি করে শাহীন বলেন, ‘আ‌মি‌ তো কোনো অন্যায় করি নাই। তারপরেও কেন কিভাবে আমাকে বরখাস্ত করা হলো আর এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার বোধগম্য নয়।

এই ঘটনায় চেয়ারম্যান শাহীন কেবল পদ হারানোর ঝুঁকিতে নন, তার সাজাও হতে পারে। কারণ, তিনি প্রথমত. অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করেছেন, দ্বিতীয়ত. প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই এই বিয়ে করেছেন। দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর তার বিয়ে করার এই ঘটনাটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছে হাইকোর্ট।

যা ঘটেছিল

কনকদিয়া ইউনিয়নের নারায়ণপাশা গ্রামের এক যুবক ও স্থানীয় মসজিদের ইমামের সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি স্থানীয় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি পরিবার। এর মধ্যে দুজন তিন দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে যায়।

পরে মেয়েটির বাবা দুজনকে পাশের বাড়ির এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ধরে নিয়ে আসেন এবং বিষয়টি সমাধানের জন্য কনকদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদারকে জানান।

চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদার শুক্রবার ইউনিয়ন পরিষদে সালিস বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে ছেলে ও মেয়ের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে মেয়েটিকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদারের। তিনি মেয়েটির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি রাজি হলে জুমার নামাজের পর চেয়ারম্যানের আয়লা বাজারের বাসায় কাজি ডেকে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে বিয়ে হয়।

এই বিয়েতে মেয়ের বয়স নিয়েও জালিয়াতি করার অভিযোগ উঠেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মেয়ের বয়স ১৮ বছর বলে সনদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে যে স্কুলে পড়ত, সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কথা শুনে অবাক হয়েছেন।

চেয়ারম্যান শাহীন আগে থেকে বিবাহিত। তার প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে কোনো অনুমতিও নেয়া হয়নি। আর এই বিয়ের পর তিনি রাগে বাবার বাড়ি চলে গেছেন।

শাহীন দুই সন্তানের জনক। ছেলেকে এরই মধ্যে বিয়ে দিয়েছেন আর মেয়ের বয়স তার নববিবাহিতা স্ত্রীর সমান।

সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তালাক

এই বিয়ের কথা জানাজানি হলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়। আর চাপের মুখে চেয়ারম্যান কথা বলেন তার কিশোরী বধূর সঙ্গে।

শনিবার রাতেই সেই কিশোরী তালাকনামায় সই করে। এরপর তাকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেয়া হয়। পরে সে তার আগের স্বামী মসজিদের ইমামের কাছে ফিরে যায়।

মেয়েটি যা বলল

চেয়ারম্যানকে তালাক দিয়ে এসে সেই কিশোরী মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে জানায়, সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার নানাবাড়ির সামনে চুনাইরপুর বায়তুল মামুন জামে মসজিদে ইমামতি করতেন রমজান আলী। তার কাছে কোরআন শরিফ পড়ত সে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়। তিন বছর ধরে চলে এই প্রেম।

ওই মসজিদেই রমজানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে বয়স কম হওয়ায় কাবিন হয়নি।

পরে বিষয়টি জানাজানি হলে কয়েক মাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল। তবে গত ১৮ মে তার বাবা-মা তার দাদির ফুফাত বোনের ছেলের কাছে বিয়ে দেন তাকে।

বিয়ের পর নুরাইনপুর বন্দরে বসে তাদের মাত্র এক ঘণ্টার জন্য দেখা হয়েছিল। গত শুক্রবার তাকে স্বামীর বাড়ি তুলে দেয়ার কথা ছিল।

মেয়েটি এর ফাঁকে রমজানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর গত ২৪ জুন তারা ঘর ছাড়ে।

বাইকে করে দুজন চলে যায় কনকদিয়া ইউনিয়নের কুম্বখারী রমজানের মামা শাহ আলমের বাড়িতে।

পরে মেয়েটির বাবা বিষয়টি চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদারকে জানান। গত শুক্রবার তিনি সালিস ডাকেন। বলেন, এর একটি ফয়সালা করে দেবেন।

মেয়েটি জানায়, তারা শাহীন হাওলাদারের বাড়ি গেলে চেয়ারম্যান তাকে অন্য একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন।

চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘ওই ছেলের তো (রমজানের) টাকাপয়সা নাই। তুমি তার ঘরে গিয়ে সুখী হতে পারবা না। বরং আমাকে বিয়ে করলে সুখী হবা।’

মেয়েটি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সে মনে করেছিল ‘বুড়ো দাদু’ (চেয়ারম্যান) তার সঙ্গে দুষ্টুমি করছেন। পরে তিনি কক্ষ থেকে বের হয়ে বলেন, রমজানকে বিয়ে করতে হলে তো আগের স্বামীকে তালাক দিতে হবে। এরপর কাজি ডেকে এনে তালাক দেয়া হয়।

এরপর চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদার তাকে প্রতারণা করে বিয়ে করেন বলে মেয়েটি অভিযোগ করেছে।

চার বিয়ে করার চ্যালেঞ্জ চেয়ারম্যানের

চেয়ারম্যান শাহীন হাওলাদারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘হয়, তালাক হইছে। খুশি হইছেন আপনারা?’

মেয়েটিকে অশালীন গালি দিয়ে তিনি বলেন, ‘তার আগের স্বামী (গালি দিয়ে অন্য শব্দ) রয়েছে।’

বয়স লুকিয়ে বিয়ের দায় মেয়েটির ওপরে দেন শাহীন হাওলাদার। বলেন, ‘জন্মতারিখ ভুল করলে হেডা ওই (গালি দিয়ে) করছে আমি তো করি নাই। আমার কাছে যে জন্মসনদ আছে তাতে বয়স ১৮ হয়েছে। ভুল করলে ওইডায় করছে আমি তো করি নাই। আপনারা আমারডা মোডা দেখছেন হেইজন্য যা ইচ্ছা তাই লিখে যাচ্ছেন, কলিজায় জোর থাকলে ওর বিরুদ্ধে ল্যাহেন। ওর বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও ও আগে এতগুলো বিয়ে করল ক্যামনে? হেইয়া ল্যাহেন।’

টানা কয়েক মিনিট এভাবে বলে চেয়ারম্যান জানতে চান ‘আর কিছু জানতে চান?’

তালাক পাওয়ার পর এখন কেমন লাগছে- এমন প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে আবার বললেন, ‘অনুভূতি অনেক ভালো। আবার বিয়ে করব। আপনার কাছে কোনো সুন্দরী মাইয়া থাকলে নিয়ে আইসেন। একটা না, এক সাথে চাইরডা বিয়ে করমু। যদি না পারি তহন কইয়েন।‘

এই বলেই ফোন কেটে দিলেন চেয়ারম্যান।

দুটি আইনের লঙ্ঘন

চেয়ারম্যানের এই বিয়েতে দুটি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। প্রথমত. তিনি বাল্যবিয়ে করেছেন, সেটি আইনে দণ্ডনীয়, দ্বিতীয়ত. তিনি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করেছেন। এ ক্ষেত্রেও সাজা হতে পারে।

বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তিনি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যে কাজী এই বিয়ে পড়িয়েছেন, শাস্তির মুখোমুখি হতে পারে তাকেও। আইনে বাল্য বিয়ে পড়ালে অনধিক দুই বছর ও কমপক্ষে ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের কথা বলা আছে।

অন্যদিকে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে এক বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা আছে।

দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৪-এর বিধান মতে, কারাদণ্ডের মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে।

হাইকোর্টের যে আদেশ

রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়।

৩০ দিনের মধ্যে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক, জেলা নিবন্ধক ও পিবিআইকে তদন্ত করে আলাদা তিনটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে।

ওই কিশোরীকে নিরাপত্তা দিতে বাউফলের এসপিকে নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ৮ আগস্ট দিন ঠিক করে দিয়েছে আদালত।

এ বিভাগের আরো খবর