থানা কম্পাউন্ডে জমে আছে শত শত ব্যাটারিচালিত রিকশা। মহাসড়ক থেকে জব্দ হওয়া এসব থ্রি-হুইলারের অনেকের বয়স মাস পেরিয়ে বছর গড়িয়েছে। আইনি জটিলতায় আটকা পড়ে থানা কম্পাউন্ডেই এখন বিকল যানগুলো।
দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় হ্যান্ডেল, চাকা, প্যাডেল, সিটে জড়িয়েছে লতা-গুল্ম। কাঠের তৈরি বডি গুলো নষ্ট হয়ে এতে জন্মেছে পরগাছা।
তবে এই রিকশা জব্দ হওয়ার আগে এক সময় সচল ছিল। যাত্রী আনা-নেয়া করে আয় করতেন দরিদ্র চালকরা। উপার্জনের একমাত্র পথ হারিয়ে অসহায় অবস্থা তাদের।
থানা কম্পাউন্ডের ভেতর কেবল অনাদরে ফেলে রাখা হয়েছে এমন না, ব্যাটারি খুলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে অনেকগুলোর। যদিও পুলিশের দাবি, ব্যাটারি আগে খোয়া যেত, এখন না।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভার হাইওয়ে থানা ফটকে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে জটলা। দেখা যায়, ময়লা পোশাক আর মলিন চেহারার কিছু মানুষকে। দিনের পর দিন হাইওয়ে থানার সামনে নিজের উপার্জনের বাহনটি পাওয়ার আশায় বসে থাকেন বলে জানান তারা। কখনও অনেক রাতেও দেখা যায় তাদের।
গাজীরচট সোনিয়া মার্কেট এলাকার রিকশাচালক জাহাঙ্গীর আলম আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুনিয়াত আমার মা-বাপ কেউ নাই। ম্যালা কষ্টের পর ধারদেনা কইরা ২৫ হাজার ট্যাকা দিয়া একটা সেকেনহ্যান (পুরাতন) রিকশা কিনছিলাম।
‘রিকশাডা আমার তিন মাস আগে বাইপাইলে ট্রাফিক পুলিশে আটকাইছিল। আমি ছাড়বার চাই নাই। ম্যালা কান্নাকাটি করছিলাম কিন্তু পুলিশে ছাড়ে নাই। আমারে মাইরধর কইরা রিকশাডা হ্যারা নিয়া গেছে। পরে হাইওয়ে থানায় আটকায় রাখছিল। ওইহানে সকাল থাইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন গেছি হ্যারা একটা টোকেন ধরায় দিছিল। কিন্তু রিকশাডা ছাড়ে নাই।
‘পরে ম্যালা দিন পর রিকশাডা হ্যারা ছাইরা দিছে। কিন্তু তহন রিকশার ব্যাটারি দুইডা আছিল না। হ্যাগো জিগাইছি, স্যার আমার ব্যাটারি কো? তহন হ্যারা আমারে খ্যাদায় দিছে। ওই রিকশা নষ্ট হইয়া গেছিল। পরে ভাঙারি হিসাবে ব্যাচতে হইছে। এহন মাইনসের রিকশা দিন হাজিরায় চালাই। অ্যার মইদ্দে শুনতাছি সরকার রিকশা বন্ধ কইরা দিবো। তাহলে আমরা কই যামু? আসলে গবিবের কষ্টই থাইকায় যাইব। আমাগো দ্যাখার কেউ নাই।’
শিমুলতলা এলাকার রিকশাচালক শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখন বাইপাইল যাই ওই খানে আমাদের ধরে। ধইরা প্রশাসনের কিছু লোক থাকে, আবার দালালের মতো সিভিলেও কিছু লোক থাকে। এরা আমাদের গাড়ির চাবি থাবা দিয়া নিয়া যায়। নিয়া যাইয়া কয় গাড়ি সাইড কইরা রাখে।
“কয়, ‘ছার’ আসপো তারপর গাড়ি ছাড়মু। পরে ছার আসলে বলে, টাকা দাও এক হাজার গাড়ি নিয়া যাও। যদি টাকা দেওয়া না হয় ওনারা বলে গাড়ি আমরা নিয়া যাব। পরে ওনারা গাড়িটা হাইওয়ে থানায় নিয়া যায়গা।
‘ওই গাড়িটা আনতে পরে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়। তো ওই টাকা আর আমরা যোগাইতেও পারি না গাড়িটাও আর আনতে পারি না, গাড়িটাই আমাদের শেষ হইয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমার গাড়িটাও একবার ধরছিল। ধার কইরা ট্রাফিক পুলিশরে এক হাজার টাকা দিয়া আমার গাড়ি নিয়া আইছি।’
নবীনগর এলাকার রিকশাচালক আল আমিন বলেন, ‘টাকা না দিলে রিকশার টায়ার কাইটা দ্যায়। ঘাও দিয়া রিকশা ছিদ্রি কইরা দ্যায়। রিকশা আর চাবি নিয়া দুই ঘণ্টা বহায় রাইখা দ্যায়। এক হাজার ট্যাকাও নিয়া স্লিপ দিয়া পুলিশ রিকশা ছাইরা দ্যায়।’
তিনি বলেন, ‘এক যদি ব্যাটারির দোকান বন্ধ কইরা দিত তালি আমরা ব্যাটারি কিনবার পারতাম না। রিকশাও চালাইতে পারতাম না। এম্বুরা ব্যাটারি আলার দোকান ঠিকি চলে, উম্বুরা আমরা ব্যাটারি কিনতে পারি, উম্বুরা আবার পুলিশে আমাদের অত্যাচার করে। তা আমরা কী করমু?’
থানার সামনে একবার আল আমিনের রিকশা ধরেছিল পুলিশ। তখন তিনি এক হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন। বলেন, ‘না দিলি পরে রিকশা লিয়া যাইত। কষ্ট করি হলিও টাকাটা দিছিলাম।’
তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অভিযোগের বিষয়ে বাইপাইল ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর খসরু পারভেজকে একাধিকরা ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
তবে থানা কম্পাউন্ড থেকে আগে ব্যাটারি চুরি যাওয়ার ঘটনা স্বীকার করলেও তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এর পুনরাবৃত্তি হয়নি বলে দাবি সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ করিম খানের। রিকশচালকদের অন্যান্য অভিযোগ অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সাধ্যমত ব্যাটারিচালিত থ্রিহুইলার যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে আমাদের জনবল ও জব্দকৃত যানগুলো রাখার স্থান সংকট রয়েছে। থানা কম্পাউন্ডে বর্তমানে ৩০-৪০টা গাড়ি (অটোরিকশা) আছে। আইনগত জটিলতার কারণে এসব যান এখানে আছে। পরে এ গুলোর বিরুদ্ধে মামলা ও ডাম্পিং করা হবে।’
থানা কম্পাউন্ড থেকে থ্রিহুইলারের ব্যাটারি চুরি যাওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘না, এখন এরকম কোনো ঘটনা নাই।’