হাকডাকে সরগরম ঢাকার সাভারে বাইপাইলের বাস কাউন্টারগুলো। খুঁটিতে ঝোলানো মাইক, আবার হ্যান্ডমাইকে ডেকে আনা হচ্ছে যাত্রী। ডাকাডাকি চলছে খালি মুখেও। দেশের উত্তরাঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রী ঠাসাঠাসি করে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছেড়ে যাচ্ছে মাইক্রোবাস।
বুধবার দুপুরে বাইপাইল আজিজ পাম্পের সামনে এমন চিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই, মারাত্মক করোনা সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আশপাশের চার জেলাসহ সাত জেলায় মঙ্গলবার থেকে ৯ দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। জেলাগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী। এসব জেলায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সোমবার সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকবে। মানুষও যাতায়াত করতে পারবে না। পণ্যবাহী ট্রাক এবং অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কিছুই চলবে না।’
তবে বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই ঢাকার প্রবেশমুখ বাইপাইল থেকে অবাধে যাত্রী বোঝাই করে সংক্রমিত এলাকাগুলোতে যাচ্ছে মাইক্রোবাস। সুযোগ বুঝে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বাসও।
স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবারও ৫০-৬০টি মাইক্রোবাস এখান থেকে ছেড়ে গেছে। নিয়ম না মেনে লোকাল বাসগুলোকেও যাত্রী বোঝাই করে চলাচল করতে দেখা গেছে।
এসব পরিবহনে যাত্রীদের কাছে ভাড়াও বেশি নেয়া হচ্ছে কয়েকগুণ। চারশ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যাত্রীদের যারা মাইক্রোবাসে তুলে দিচ্ছেন তারা মূলত কাজ করছেন মধ্যস্বত্ত্বভোগী হিসেবে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় কাউন্টারের স্টাফরাই মূলত এই কাজ করছেন। কমিশন হিসেবে মাইক্রোবাস চালকদের কাছ থেকে যাত্রী প্রতি যাত্রী প্রতি ২০০ টাকা নিচ্ছেন তারা।
স্ত্রীকে রংপুর পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন শাহিন আলম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওর ভাইভা ছিল চট্টগ্রামে। কাইলকা এখান থেকে চট্টগ্রামে যাইতে পারে নাই। আবার রংপুরে ক্লিনিকে চাকরি করে। আইজকা না গেলে চাকরি থাকবে না। ভাড়াতো ১০০০ টাকা করে নিচ্ছে। যতটা সিট ততজন নিচ্ছে। আমাদের বলছে ১৩ জন যাবে।’
করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি পাত্তা না দিয়ে গাদাগাদি করে কেন যাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যাতো হবে। উপায় নাইতো। নিরুপায় হয়েই যাওয়া লাগবে। গাড়ি-ঘোড়া তো নাই।’
আরেক মাইক্রোবাসের যাত্রী শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এক হাজার টাকা ভাড়া নিচ্ছে। আমার বাড়িতে যেতেই হবে। বাড়িতে সমস্যা। কী করবো আমি?’
বগুড়ার যাত্রী আশারফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গাদাগাদি হলেও কিছু করার নাই ভাই। আমাদের বাড়িত যেতে হবে। ভাড়া ৬০০ টাকা নিছে।’
বাড়তি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করেই বাড়ি ফেরার চেষ্টায় যাত্রীরাকাউন্টারের সামনে মাইক্রোবাসে বগুড়ায় পাঠানোর জন্য ভাইকে উঠিয়ে দিচ্ছিলেন হাসান নামে এক ব্যক্তি।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষ ভুগতে ভুগতে এমন এক জায়গায় চলে গেছে যাওয়ার আর জায়গা নাই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। গত রমজানের ঈদে মানুষ বাড়ি যাইতে পারে নাই। বিশেষ করে যারা মিডল পর্যায়ের মানুষ। তারা চিল্লাই কাঁদতে পারে না। তাদের লাইফটা শেষ।’
হ্যান্ডমাইকে ডেকে মাইক্রোবাসে তুলছিলেন আরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘নাটোরে যাইতেছে হায়েস। ভাড়া ৮০০। নয়জন করে যাইতেছে হায়েসে। কেবল বসাইছি দুইজন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাইক্রোবাস চালক বলেন, ‘গাড়ি না চালালে আমাদের খাবার দিবে কে? রাস্তায় পুলিশ আটকায়। কখনও ছাড়ে আবার কখনও ছাড়ে না। মামলা দিয়ে দেয়। লোকজন তো যায়। আমাদের কী করার আছে?’
এই প্রতিবেদককে দেখে কাউন্টার বন্ধ করে চলে যান গ্রামীণ, এমভি, শেরপুর ট্রাভেলসের কাউন্টারে থাকা একজন। কাউন্টারের ভেতরেও অপেক্ষায় বেশ কয়েকন যাত্রী। তবে তারা কথা বলতে রাজি নন।
বগুড়ার হানিফ পরিবহনে যাত্রী উঠানোর সময় নিউজবাংলার প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করতেই তাকে ম্যানেজ করতে ছুটে আসেন কন্ডাক্টর রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ছবি তুলা লাগবি না। এদিকে আসেন। এডা ফিরতি গাড়ি। একটা যাত্রীও হয় নাইক্যা। তিন দিন হল না খাইয়া আছি। কেউ কি ১০ ট্যাকা দিবি? হায়েসের মইদ্দে গাদাগাদি করি যাচ্ছি সেইটা ধরিচ্চেন না কেউ। আর গাড়িয়ালারা মনে করেন দুই সিটে একজন নিলে সমস্যা।’
পুলিশ ধরে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় পুলিশতো ধরেই। বাস ১৫০০- ২০০০ ট্যাকা জরিমানা কইরা ছাইড়া দেয়। হায়েস আর মাইক্রো ৫০০-১০০০ ট্যাকা দিলেই ছাড়ে। ওগোতে সমস্যাই নাই।’
এ বিষয়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও ট্রাফিক বিভাগ) আব্দুল্লাহ হিল কাফী বলেন, ‘নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের নন্দন ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বাড়ইপাড়ায় আমাদের চেকপোস্ট আছে। কোনো গাড়ি সাভার থেকে পাশের জেলা মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরে প্রবেশ করতে পারবে না। বিকল্প রুট ধামরাইয়ের কালামপুর হয়ে মির্জাপুরগামী অনেক বাস আটক করা হয়েছে। লোকাল বাসেও যারা অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’