বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৬ মাসের কাজ শেষ হয়নি ৫৪ মাসেও

  •    
  • ২৩ জুন, ২০২১ ১১:১৯

বিতর্কের মুখে কয়েক বছর আগে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বনসাই লাগানোর কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে চলতে থাকে শোভাবর্ধন ও ডিজিটাল সড়কে রূপান্তরের কাজ। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত এই প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও বড় বড় স্ক্রিনে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। সড়কের পাশে দেয়া হয়েছে ফার্মেসি ও ফাস্টফুডের দোকান।

ছয় মাসের মধ্যে চীনের সাংহাই বা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরের মতো ঢাকার বিমানবন্দর সড়কটি দৃষ্টিনন্দন করে ডিজিটাল সড়কে রূপান্তরের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের শুরুতে।

তবে ২০২১ সালের জুন মাসের শেষ দিকে এসেও শেষ হয়নি ‘বনানী ওভারপাস থেকে বিমানবন্দর মোড় সৌন্দর্যায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ। কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

চীনের ফুজহৌ রিয়েলিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এ কাজ করছে ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিতর্কের মুখে কয়েক বছর আগে প্রকল্পের আওতায় বনসাই লাগানোর কাজ বন্ধ করে দেয় তারা।

তবে বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারে চলতে থাকে শোভাবর্ধন ও ডিজিটাল সড়কে রূপান্তরের কাজ।

প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প চলমান হওয়ায় সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই দুটি মেগা প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত সড়কটিকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল রূপ দেয়া ও এর সৌন্দর্যবর্ধন সম্ভব হচ্ছে না।

বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের জুনে। আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত) কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের মার্চ থেকে এপ্রিলে।

এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের জুন মাসের আগে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নিউজবাংলাকে তারা জানান, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে শুরু হয় সৌন্দর্যবর্ধনের পাইলট প্রকল্প। সেটি সফল হওয়ার পর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ‘বনানী ওভারপাস থেকে বিমানবন্দর মোড় সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প’ নামের এই প্রকল্প শুরু হয়। ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ শুরু করে ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ।

পুরো কাজ তত্ত্বাবধানে আছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ তাদের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) ফান্ড থেকে ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা জানায়।

সওজের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, বাস্তবায়নের পর ১০ বছর পর্যন্ত প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। সে জন্য বছরে ৫ কোটি টাকা হিসাবে ১০ বছরে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

সব মিলিয়ে প্রকল্পটির জন্য সিএসআর ফান্ড থেকে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয় করবে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিময়ে প্রকল্প উদ্বোধনের পর থেকে সড়কের বিভিন্ন স্থানে তারা দোকান ও বিজ্ঞাপন ভাড়া দিয়ে ‘কিছুটা’ খরচ তুলবে।

সম্প্রতি বিমানবন্দর সড়ক ঘুরে দেখা যায়, বনানী লেভেল ক্রসিং থেকে শুরু করে বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত সড়কের পাশে বেশ কয়েকটি স্থানে যাত্রীছাউনি, বসার বেঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধনে বিভিন্ন ধরনের গাছও লাগানো হয়েছে।

এসবের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। কোথাও তোলা হয়েছে ভবনের ভিত্তি, কোথাও দেয়াল। এর কোনোটিতেই যত্নের কোনো ছাপ নেই।

ডিজিটাল সড়ক হিসেবে ওয়াইফাই সুবিধা থাকার কথা থাকলেও কোথাও ওয়াইফাই সংযোগ পাওয়া যায়নি। কোনো যাত্রীছাউনির কাজই শতভাগ শেষ হয়নি।

ছাউনিতে মোবাইল ফোনের চার্জের পয়েন্ট থাকলেও সেগুলো ঢাকা রয়েছে। কয়েকটি যাত্রীছাউনিতে রয়েছে ‘অত্যাধুনিক স্ক্রিন’, যেগুলোতে মাঝেমধ্যে বিজ্ঞাপন চলতে দেখা যায়।

প্রকল্প এলাকায় কয়েকটি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। রয়েছে আরও কিছু অবকাঠামো। তবে টয়লেটসহ এসব অবকাঠামো তালাবদ্ধ।

নিকুঞ্জ গেটের কাছে নজরে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত একটি ভাস্কর্য, যার নাম ‘বীর’। তবে আর্মি গলফ ক্লাবের সামনে শেওড়া এলাকায় এবং বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সামনে কোনো ধরনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চোখে পড়েনি।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে একটি ফার্মেসি এবং ঠিক বিপরীত পাশে একটি মিনি ফাস্টফুডের দোকান দেখা যায়।

ফার্মেসির এক কর্মচারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই দোকানের মালিক ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের মালিক আবেদ মনসুর সাহেব। উনিই এটা দেখাশোনা করেন। আর ওই পাশের ফাস্টফুডের দোকানও মনসুর সাহেবের কাছের লোক চালায়।’

কুড়িল বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় সোহেল শাহরিয়ার নামে এক চাকরিজীবীর সঙ্গে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার কর্মস্থল কারওয়ান বাজার আর বাসা কুড়িল কাজী বাড়ি এলাকায়। প্রতিদিনই আমাকে এখানে এসে বাসে উঠতে হয়। গত কয়েক বছর ধরেই দেখছি এখানে অর্ধেক কাজ করে রাখা হয়েছে।

‘যাত্রীছাউনি বানাইছে। কিন্তু কাজ শেষ করে নাই। পত্রিকায় দেখেছিলাম এই রেললাইনের ওপর একটা ওভারব্রিজ হবে। কই? হইল না তো। কয়েক বছর আগেই শুনেছিলাম, ছয় মাসেই নাকি এটা ডিজিটাল সড়ক হবে। কই? হইল না তো।’

ছয় মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫৪ মাসেও কেন হয়নি, তা জানতে কথা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের সিইও আবেদ মনসুরের সঙ্গে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প এলাকার কিছু জায়গায় থার্ড টার্মিনালের কাজ চলছে। কিছু জায়গায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসের কাজ চলছে। কিছু জায়গায় রেলের কাজও চলছে। এসব জায়গা ছাড়া আমাদের প্রায় সব কাজই শেষ।

‘ওই সব জায়গায় আমরা কাজ করছি না। কারণ আজ কাজ ধরলে কালই দেখা যাবে মেগা প্রকল্পের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হচ্ছে। এতে শুধু শুধু টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না।’

ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের সিইও আবেদ বলেন, ‘ওইগুলো হলো জাতীয় প্রকল্প। ওই প্রকল্প বন্ধ করে তো আর আমার এই ছোট প্রকল্পের কাজ করতে পারি না। তা ছাড়া ওই সব প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ তাদের কাজ শুরু করার আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে কোথায় কোথায় তারা কাজ করবে। তাই ওই সব জায়গায় আমরা কাজ করিনি।

‘তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা যখন উপরের গার্ডারের কাজ শেষ করবে, তখন তাদের আর নিচে কাজ থাকবে না। তখনই আমরা আমাদের কাজ শেষ করব।’

সব মিলিয়ে খুব সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে বলে দাবি করেন তিনি।

আবেদ মুনসুর বলেন, ‘প্রকল্পটি আমরা আমাদের কোম্পানির সিএসআর ফান্ড থেকে বাস্তবায়ন করছি। তাই আমরা এখানে আমাদের লাভ-লোকসানের কথা ভাবি না।’

প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই দোকান ভাড়া আর বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই ফার্মেসিও আমাদের সিএসআর ফান্ডের টাকায় করা। এখানে কমন কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো আমাদের সবারই প্রয়োজন হয়।

‘সেগুলো আমরা এখানে অনেক কম টাকায় বিক্রি করি। যে বিজ্ঞাপন ভাড়া পাই, তা আমাদের মোট বিনিয়োগের তুলনায় খুবই সামান্য। এটা লাভের জন্য করছি না।’

আবেদ মনসুর বলেন, ‘এখানে আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি ৯০ কোটি টাকায়। বছরে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

‘মোট ১০ বছর এই রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ আমাদের খরচ হবে ৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ হবে ১৪০ কোটি টাকা। এসবই আমাদের কোম্পানির সিএসআর ফান্ডের।’

প্রকল্পের পুরো কাজ তত্ত্বাবধানে আছে সওজ। বিভাগের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের কাজ চলার কারণে এসব এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে।

‘কোথাও পাইলিং হয়েছে, কোথাও পাইলিং হবে, যে কারণে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের অনেক জায়গায় অর্ধেক কাজ হয়ে পড়ে আছে। এই খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যে তো আর আমরা এই কাজ করতে পারি না। মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে আমরা এই কাজ এগিয়ে নেব।’

প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার আগেই দোকান চালু ও বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ অনুমতি নিয়েছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয় সওজের প্রকৌশলীর কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, ‘এতে ওইভাবে আমাদের অনুমোদন নেই। কিন্তু যেহেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা ইনভেস্ট করছে, তাই তারা এটা করছে মনে হয়।’

প্রকল্পে যা যা হওয়ার কথা

‘বনানী ওভারপাস থেকে বিমানবন্দর মোড় সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প’ নামে বনানী লেভেল ক্রসিং থেকে বিমানবন্দর মোড় পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কে ডিজিটাল সেবার সুবিধা রেখে অবকাঠামো স্থাপনের কথা রয়েছে।

এই সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন স্থানে থাকবে ১২টি মিনি পাহাড়ি ঝরনা। ফুটপাতে থাকবে দৃষ্টিনন্দন ফুল, সবুজ পাতার বাহার।

বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জন্য থাকবে ১২টি ডিজিটাল যাত্রীছাউনি, যেখানে থাকবে ওয়াইফাই ও মোবাইল চার্জের সুবিধা। থাকবে বিশুদ্ধ পানিও।

কয়েকটি ব্রেস্ট ফিডিং পয়েন্ট থাকবে সড়কের পাশে। থাকবে ডিজিটাল পুলিশ বক্সও।

নিকুঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত থাকবে সাইকেল লেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকাশ থাকবে সড়কের তিনটি ভাস্কর্যে।

নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকবে বিজ্ঞাপনের ডিজিটাল বিলবোর্ড, ডিজিটাল ডাস্টবিন, ডিজিটাল ট্রাফিক সাইন, স্বয়ংক্রিয় ধুলা পরিষ্কারের যন্ত্র, এলইডি স্ট্রিট লাইট, এলইডি অর্নামেন্টাল গার্ডেন লাইট।

নিকুঞ্জ অংশে শিশুদের জন্য থাকবে কিড জোন। পুরো সড়ক থাকবে ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার আওতায়।

এ বিভাগের আরো খবর