মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পর টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে পলিথিনে ছাওয়া ঘরের ঘিঞ্জি শিবিরেই বাস রাবিয়া খাতুন ও তার পাঁচ সন্তানের। রোহিঙ্গাদের যে আবারও মিয়ানমারে ফেরানোর চেষ্টা চলছে, সেই খবরটি জানেন রাবিয়া।
দেশে ফিরতে চান কি না, এমন প্রশ্নে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন তিনি।
‘না, না অভাইয়ান, আঁরা আর পিরতাম ন’ ছাই (না না ভাই, আমরা আর ফিরতে চাই না)। ইতারা যেল্লেই কথা দক, ইতারা এন্ডে নিয়েরে আঁরারে মারি ফেলাইবু (মিয়ানমার যে কথাই দিক না কেন, তারা ওখানে নিয়ে আমাদের মেরে ফেলবে)। মরিলে বাংলাদেশত মইজ্জুম (মরলে বাংলাদেশেই মরব)। এন্ডে ত হনো রহম দুইবেলা ভাত অইলও জুডের (এখানে কোনো রকম দুই বেলা ভাত হলেও জুটে)। বার্মাত ন হাই মরিয়ুম (মিয়ানমারে না খেয়ে মরে যাব)’, বলেন রাবিয়া।
বেঁচে থাকাটা যেখানে দুঃস্বপ্ন, স্বদেশের আলো যেখানে শরীর ঝলসায়, প্রিয় জন্মভূমির মাটি যখন পরিণত হয় মৃত্যুকূপে, তখন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাবিয়ার মতো লাখো রোহিঙ্গা ফিরতে চান না প্রিয় ভূমিতে।
এমন পরিস্থিতিতে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার নিয়ে ২০ জুন বাংলাদেশে পালন হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস।
দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় শিবির কুতুপালংসহ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নানা কর্মসূচি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ্ রেজওয়ান হায়াত নিউজবাংলাকে বলেন, বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। শরণার্থী দিবসটি উদযাপন করতে রোহিঙ্গা শিবিরে বেশ কিছু প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
মিয়ানমারে যথেষ্ট নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ক্ষতিপূরণ দেয়া না হলে ফিরবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
শনিবার লেদা আশ্রয় কেন্দ্রে দেখা যায়, সরু গলির দুই পাশে লম্বা করে একেকটি ঘর। বাঁশের বেড়ার উপরে ত্রিপল ছাউনি। বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে আশ্রয়কেন্দ্রের এই অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ অত্যন্ত ঘিঞ্জি হলেও সুপেয় পানি আর স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে। এই দুই সুবিধার কারণেই এখানকার বাসিন্দারা সন্তুষ্ট।
লেদা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ সৈয়দ আলম। এখন তার বয়স ২৬। ১১ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশে আসেন।
আলমের বাবা নেই; মিয়ানমারের মংডুতে সেনাবাহিনী তাকে (বাবা) খুন করেছিল।
এ যুবক বিয়ে করেছেন। আছে দুটি ছেলে।
‘আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার দিতে হবে। আমাদের জায়গা-জমি ফিরিয়ে দিতে হবে, নয় তো আমরা মিয়ানমারে ফিরব না’ বলেন মোহাম্মদ সৈয়দ আলম।
লেদা ক্যাম্পের একটি দোকানের সামনে বসে গল্প করছিলেন ৮ থেকে ৯ রোহিঙ্গা। তাদের একজন ২১ বছর বয়সী তরুণ নুরুল্লাহ।
তিনি মিয়ানমারে স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। রোহিঙ্গা ভাষার পাশাপাশি তিনি বার্মা ভাষায়ও কথা বলতে পারেন।
নুরুল্লাহ বলেন, ‘মিয়ানমারের সরকার অনেক চালবাজ। বাংলাদেশে থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপে চুক্তি করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এর কোনো বিশ্বাস নেই। সেখানে ফের নির্যাতন শুরু করবে রোহিঙ্গাদের।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। তখন বাংলাদেশে আসা তিন লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে আড়াই লাখ মিয়ানমার পরে ফিরিয়ে নিয়েছিল। ১৯৯২ সালে আসে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৭ রোহিঙ্গা।
এর মধ্যে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে। ফলে প্রতিবারই কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে গেছে।
১৯৯২ সালের পর আরও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গারা এলেও তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ আর দেখা যায়নি। এরপর থেকে প্রত্যাবাসন বন্ধ হয়।
২০১২ সালের ৩ জুন মিয়ানমারে তাবলিগ জামাতের ওপর হামলা চালায় রাখাইনরা। সে সময় সংর্ঘষ শুরু হয়। সংঘর্ষ মংডু থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়।
ওই পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে পালানো শুরু করে রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের সীমান্তে পুলিশের ছাউনিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য হতাহত হয়। তখন মিয়ানমার সরকার দাবি করে, এ হামলার সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত।
পরের রাতে হঠাৎ মিয়ানমারের সেনারা সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ঘিরে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করে। ওই সময় ৭৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
সবশেষ ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪টি সীমান্তচৌকিতে একযোগে হামলা হয়। আবারও শুরু হয় অপরাধী দমনের নামে অভিযান।
পরের দিন ২৫ আগস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। তাতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফে।
প্রায় ১৬ বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি নতুন সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এমওইউ অনুযায়ী, দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে পারেনি।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চুক্তি অনুযায়ী কক্সবাজারের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও টেকনাফের কেরণতলী (নয়াপাড়া) প্রত্যাবাসন ঘাট দুটি পরিত্যক্ত হয়ে আছে। ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে স্থলপথে এবং কেরণতলী পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী হয়ে নৌপথে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল।
টেকনাফ প্রত্যাবাসন ঘাটে এক লাইনে ১১টি করে তিন লাইনে ৩৩টি টিনের থাকার ঘর, চারটি শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে।
নাফ নদীর প্যারাবনের ভেতর থেকে ১৬০ গজ লম্বা কাঠের জেটি ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আলাদাভাবে চারটি ঘর রয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) নেতা মুহিব উল্লাহ বলেন, প্রায় গত চার বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদল, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী-এমপিরা একাধিকবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তাতেও প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার প্রত্যাবাসন নিয়ে মিথ্যাচার করছে। তাই বহির্বিশ্ব থেকে মিয়ানমারকে আরও চাপ দিতে হবে। তা ছাড়া সামনে বর্ষার সময় রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বন্যা ও ভূমিধসে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে।
‘আমরা আর বাস্তুহারা হিসেবে থাকতে চাই না, নিজ দেশে ফিরতে চাই। তবে নাগরিক অধিকার, ধন-সম্পদসহ সবকিছু দিতে হবে।’
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ প্রতিদিনই বাড়ছে। এরপরও রোহিঙ্গা শিবিরে বিশৃঙ্খলা ঠোকাতে রাত-দিন দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষ রোহিঙ্গাদের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে দেশ ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে।
‘তবে রোহিঙ্গাদের তৎপরতায় নানা সামাজিক সংকট তৈরি হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’