বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘আমি বলতে পারতেছি না, আমি বলতে পারতেছি না’

  •    
  • ১৪ জুন, ২০২১ ০১:৪৩

‘আপনারা ৫ মিনিট কেমনে দেখতেছেন। আমি চার দিন ধরে… আমি পাগল হয়ে গেছি ভাইয়া। আমি সুস্থ নাই মানসিকভাবে। আমি না পাগল হয়ে গেছি ভাইয়া, আমি পাগল হয়ে গেছি। আমার জায়গায় থাকলে আপনারা কেউ কথা বলতে পারতেন না।’

গত বুধবার রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় তারকা পরীমনি।

তিনি ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি বলতে পারতেছি না, আমি বলতে পারতেছি না।’

মিনিট ১৫ কথা বলেছেন পরী। এর মধ্যে তিনি কতবার কেঁদেছেন, তার হিসাব নেই। কখনও কেঁদেছেন নীরবে, কখনও ডুকরে।

রোববার রাতে পরীমনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে একটি চিঠি পোস্ট করেন।

সেখানে কে তাকে ধর্ষণ ও হত্যার চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে কিছু জানাননি।

পরে রাত ১০টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীরা হাজির হন তার বনানীর বাসায়।

তিনি জানান, বুধবার রাত ১২টার সময় তিনি তার পূর্বপরিচিত অমি এবং কস্টিউম ডিজাইনার জিমিকে নিয়ে আশুলিয়ার বিরুলিয়ায় যান।

কেন গিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কাজের ব্যাপারে গিয়েছিলাম। অমি অনেক দিন থেকেই বলছিল একটা কাজ করতে হবে। কিন্তু সময়ের কারণে কাজের ব্যাপারে কথা বলতে পারছিলাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিচিত বলে কাজের জন্য কথা বলতে রাজি হই।’

বোট ক্লাবে যাওয়ার পরেই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।

সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন চার থেকে পাঁচ ব্যক্তি। তারা বসতে বলে প্রথমে কফি ও পরে কোক খাওয়ার প্রস্তাব দেন।

কফি আসতে দেরি হচ্ছে বলে দেয়া হয় কোক। কিন্তু সেই কোকের স্বাদ ছিল সন্দেহজনক।

ক্লাবের ভেতরে থাকা ‘মুরব্বি’ গোছের একজন নিজের নাম নাসির উদ্দিন আহমেদ বলে জানান। পরীমনি বলেন, তারা কথাবার্তার একপর্যায়ে তার মুখে মদের বোতল ঠেলে দেন। জিমিকে মারধর করেন ব্যাপকভাবে।

সঙ্গে থাকা জিমিকে নির্যাতন করা হয় বলেও আকার-ইঙ্গিতে বলেন পরী। বলেন, এরপর তাকেও নানা আজেবাজে কথা বলা হয়েছে। একপর্যায়ে সেখানে কী হয়েছে, সেটা তার মনে নেই।

এরপর তিনি নিজেকে খুঁজে পান তার গাড়িতে। তখন তার গায়ের কাপড় ছিল ছেঁড়া ও ভেজা।

পরীমনির আশঙ্কা, যিনি তাকে কাজের কথা বলে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই অমি এর সঙ্গে জড়িত। আর পুরোটাই পরিকল্পিত।

যা যা হয়েছে

ক্লাবে যাওয়ার পর কী হয়েছে, সেটা জানান পরীমনি।

বলেন, ‘একটু মুরব্বি ধরনের মানুষ। আমি দাদা বলে সম্বোধন করে সালাম দিলাম।

‘আমাদেরকে বসতে বললেন। আমরা ওই রকম পরিবেশে বসার জন্য প্রিপেয়ার্ড ছিলাম না।

সাংবাদিকদের কাছে তার ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন পরীমনি

‘জিমি আমাকে বলে, দায়িত্ব আমার, আমি কথা বলছি ওদের সাথে। অন্য একদিন বসব।’

ওদের একজন তখন বলেন, ‘আরে বসেন না, গ্লাস দাও, এই সেই।’

পরী বলেন, ‘আম্মু অসুস্থ যাই।’এরপর তাদেরকে বলা হয়, ‘ঠিক আছে, কফি খাও।

‘বলছে (ওয়েটারদের) কফি নিয়া আস।’

পরী বলেন, ‘বললাম ঠিক আছে কফি খাওয়া যায়। আমি বসে আছি। কিন্তু দেরি হচ্ছিল।

‘তখন বারবার বলছি, আরেক দিন কফি খাব, কোনো সমস্যা নাই।…কফির আগে কোক চলে আসে। কোকটা ওরা গ্লাসে ঢালে।‘

সেই কোকে কিছু একটা মেশানো ছিল বলে ধারণা পরীর। বলেন, ‘এটা কোক, কিন্তু কেমন লাগতেছে! কফিও চলে আসে।

‘কফি আবার দুইটা কাপের মধ্যে মিলানো হয়। জিমি ফার্স্ট টাইম কফি আর পরে কোক ট্রাই করে। বলে, এটা কেমন জানি।’

জিমি তখন বলেন, ‘আপু তুমি দেখ এটা কফি না।’

পরী বলেন, ‘আমি মুখে নিয়ে.. টিস্যু ছিল সামনে, টিস্যুতে মুখটা মুছি।’

তখন তারা রিঅ্যাক্ট করে। বলে, ‘এটা বোট ক্লাবের কফি, মুছে ফেললেন?’

পরী তখন ‘স্যরি' বলেন।

জিমি তখন বলেন তিনি, বাথরুমে যাবেন।

পরী বলেন, ‘আমাকে বসায়ে রেখে বলে, আরে আপনি কেন যাবেন, এমন বলে জিমিকে নিয়ে দুইজন বাথরুমে গেল।

‘কয়েক মিনিট পরে জিমি চিল্লাতে চিল্লাতে বাথরুম থেকে বের হলো।

‘ওইটা দেখার পর আমি আর কোনো কথা বলতে পারি নাই’ এটুকু বলে কাঁদতে থাকেন পরীমনি। কিছুক্ষণ নীরবে কাঁদেন। পরে কাঁদতে থাকেন উচ্চৈঃস্বরে।

বলেন, ‘(জিমিকে দেখে) কেউ বলতে পারত না। আমি শকড হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বসেছিলাম।‘

জিমি তখন পরীকে বলেন, ‘আপি চলো, আপি চলো, আমাকে বাসায় নিয়ে যাও।’

পরী বলেন, ‘ওর অবস্থা আমি আপনাদেরকে বলতে পারতেছি না ভাইয়া,’ এটা বলে আবার কাঁদতে থাকেন।

একপর্যায়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পরী বলতে থাকেন, ‘যখন আমি উঠে চলে আসতেছি, তখন আমার চেয়ারের ওপরে চেয়ারে… চেয়ারের মধ্যে লাত্থি মেরে… আমি চলে আসি পেছনে।’

উত্তরা বোট ক্লাবের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

কিছুক্ষণ থেমে আবার কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘লাইনগুলো কীভাবে বলতে হবে, আমি না আসলে বলতে পারতেছি না।’

এরপর পরী আবার উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে থাকেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমি বলতে পারতেছি না, আমি বলতে পারতেছি না।’

পরে আবার বলেন, ‘আমি কারে বলব?’

তখন পরীকে বলা হয়, ‘তুই কি মদ খাস না?’

পরী আবার বলেন, ‘আমি বলতে পারতেছি না, ভাইয়া আমাকে মাফ করেন।’

‘আম্মু আমি পারব না’-পাশে থাকা নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বলেন পরীমনি।

চয়নিকা বলেন, ‘না বললে তো ওরা জানবে না।’

পরী বলেন, ‘আমি কেমনে বলব? এটা ওরা বুঝছিল যে আমি বলতে পারব না, আমি চুপ হয়ে যাব। আমি কেমনে বলব?’

সেদিনের ঘটনায় আবার ফিরে যান পরীমনি।

বলেন, ‘চেয়ারের ওপরে এখানে পা তুলে দিছে। আমার দাঁত এখনও নড়তেছে। এখনও ব্যথা, বোতল মুখে ভরে দিছে, মদ খাইতে হবে।’

আবার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার নাক দিয়া বের হইছে।’

সে সময় পরীকে হত্যার হুমকি দেয়া হয় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘বলছে, এইখানে ডোবা আছে, কাইটা তিন শ টুকরা কইরা ভাসায়া দিব।

‘বেনজীর আহমেদ তোর বাপ লাগে? তোরে বাঁচাইব? তোর বেনজীর আহমেদরে ফোন দে’- এই কথা বলে সেই ব্যক্তি তার ফোন ছুড়ে মারেন পরীমনির দিকে।

এর আগে সঙ্গে থাকা জিমির ফোন তারা ফেলে দেয়। কারণ, তিনি ভিডিও করছিলেন।

পরী বলেন, ‘জিমিরে অনেক মারছে ভাইয়া।’

তখন জিমিকে উদ্দেশ করে আজেবাজে কথা বলা হয়।

পরী বলেন, ‘এই কে এই হিজড়া-জিমিকে এসব এসব কথা বলছে।

‘বলে বামেরটা ভালো লাগে, ডানেরটা ভালো লাগে?’

পরীমনি তখন বলেন, ‘আমি বলতে পারব না, মারেন, মারেন, মাইরা ফালান না কেন। আমি অ্যাকটিং করি। আমাকে মাইরা ফেলেন ভাইয়া, এই দিন আমি দেখতে চাই না। আমি জানি না এই দিন আসবে। আমারে মাইরা ফেলেন ভাই।’

পরীমনি বলেন, তাকে বলা হয়, ‘ন্যাকামি করস, ন্যাকামি করস?

‘এখানে খাইতে পারবি না, নিতে পারবি না, কী কী বলছে, আমি না বলতে পারতেছি না ভাইয়া, আমার বলতে ইচ্ছা করতেছে না, আমি বলতে পারতেছি না’-এটা বলে আবার ডুকরে কাঁদতে থাকেন পরীমনি।

পরে বলেন, ‘আপনারা ৫ মিনিট কেমনে দেখতেছেন। আমি চার দিন ধরে.. আমি পাগল হয়ে গেছি ভাইয়া। আমি সুস্থ নাই মানসিকভাবে। আমি না পাগল হয়ে গেছি ভাইয়া, আমি পাগল হয়ে গেছি। আমার জায়গায় থাকলে আপনারা কেউ কথা বলতে পারতেন না।’

কে সেই ব্যক্তি

পরীমনি বলেন, ‘নাসির উদ্দিন মাহমুদ।’

উত্তরা বোট ক্লাবের ওয়েবসাইটে গিয়ে নাসির উদ্দিন আহমেদ নামে একজনকে পাওয়া যায়। তিনি সেই ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট।

নাসির জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি কুঞ্জ ডেভেলপার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান। উত্তরা ক্লাব লিমিটেডের ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছিলেন লায়ন ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের ডিস্ট্রিক্ট চেয়ারম্যান।

তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

নাসির উদ্দিনকে আগে থেকে চিনতেন কি না, এমন প্রশ্নে পরীমনি বলেন, ‘না, না না না না।’

তিনি যে নাসির উদ্দিন সেটা কীভাবে জানলেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা উনি বলছে। উনি বলছে আমি এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, এই খানের প্রেসিডেন্ট।

‘অকথ্য ভাষায় কী কী বলছে, আমি বলতে পারতেছি না ভাইয়া, আমি এই করব, সেই করব, দেখি তোকে কে আটকায়?’

আপনি কি এর আগে কখনও দেখেছেন?-এমন প্রশ্নে পরীমনি বলেন, ‘আমি তো জানতামই না যে সেখানে তারা থাকে।’

সেখান থেকে মুক্তি কীভাবে

পরীমনি জানেন না, কীভাবে তিনি সেখান থেকে এসেছেন।

তিনি জানান, রাতে একপর্যায়ে তিনি নিজেকে তার গাড়িতে আবিষ্কার করেন।

পুলিশের সহযোগিতা মেলেনি

পরীমনি জানান, তিনি সে সময় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ কল দেন। তখন সেখান থেকে ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়।

পরী তাদের বলেন, ‘উত্তর থানা না দক্ষিণ থানা আমি জানি না। এটা বোট ক্লাব।’

তবে পুলিশ যায়নি।

এরপর তিনি বাসায় চলে আসেন। সেখানে কথা বলেন তার মামা দিপুর সঙ্গে।

তিনি বলেন, বাসায় এসে দিপুকে তিনি থানায় নিয়ে যেতে বলেন।

বনানী থানায় গিয়েও প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেন পরী।

তিনি অভিযোগ দিতে গেলে পরে কী হয়েছে, এমন প্রশ্নে পরী বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে, স্যার ১০টায় আসবেন।

‘আমি বলছি আমি ফিজিক্যালি আনফিট। আমি ঠিক নাই ভাইয়া, আমাকে কী কী খাওয়ানো হয়েছে আমি জানি না। আমার না অস্থির লাগতেছিল। আমার কেমন লাগতেছিল আমি নিজেই বুঝতে পারতেছিলাম না।’

এরপর পুলিশকে হাসপাতালে নেয়ার অনুরোধ করেন পরী। বলেন, ‘হসপিটালে নিয়ে যান আমাকে; টেস্ট করার জন্য। পয়জন খাওয়ালে তো আমি মরে যাব, আমাকে সেভ করেন।’

পরীকে সেখান থেকে নেয়া হয় বসুন্ধরা এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে তাকে রেখে পুলিশ চলে আসে।

পরে পরী ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে আসেন।

বলেন, ‘তখন আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি সেখানে গিয়ে কী করব? যদি আমাকে ইনজেক্ট করে মেরে ফেলা হয়?...উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে। হতে পারে ড্রাগের কারণে।’

কী বলছে বনানী থানা?

পরীমনির এই অভিযোগ নিয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আজমের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে নিউজবাংলার।

পরীমনি যে তার থানায় গিয়েছিলেন, সেটি প্রথমে তিনি স্বীকারই করেননি। প্রথমে বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন।

পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘না, থানায় এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসে নাই।’

এ বিভাগের আরো খবর