বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশু শ্রমিক কত, জানে না কেউ

  •    
  • ১২ জুন, ২০২১ ০০:২৩

সরকারের অঙ্গীকার ছিল ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম শূন্যে নামিয়ে আনার। সে মেয়াদ পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে। আইএলও ২০২৫ সালের মধ্যে তা নিরসন করতে চায়।

শুক্রবার সকাল। রাজধানীর ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেটমুখী লেগুনায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে ফারুক। বয়স ৯ বছর থেকে বড়জোর ১১। ভেতরে চারজন করে আটজন যাত্রী বসলেও হেলপার হিসেবে সব সময়ের মতোই তার জায়গা লেগুনার পটাতনে।

পাটাতনে আরও দুজন বাড়তি যাত্রীকে জায়গা দিতে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। সারা দিন খেটে মজুরি ২০০ টাকা।

দেশের শ্রম আইন অনুসারে ফারুকের এমন কাজ করার কথা নয়। কিন্তু ফারুকের মতো এমন শতাধিক শিশু কাজ করছে রাজধানীর বিভিন্ন গন্তব্যের লেগুনায়। তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। জানা যায় না দেশে মোট কত শিশু শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে, কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ খাতেই বা কতজন কাজ করে। দেশ থেকে কবে শিশুশ্রম দূর হবে, তাও সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে গত দুই দশকে ৯০ হাজার শিশুকে শ্রমের বাইরে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এমন বাস্তবতায় শনিবার বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হবে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অ্যাক্ট নাউ: অ্যান্ড চাইল্ড লেবার’ (শিশুশ্রম বন্ধে পদক্ষেপের সময় এখনই)। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনায় সারা বিশ্বে শিশুশ্রম উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিশ্বে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে।

করোনার দেড় বছরে এ নিয়ে কোনো জরিপ বা গবেষণা করেনি বাংলাদেশ। ফলে, বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত তা সরকার জানে না। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেরও গবেষণা নেই। ২০১৩ সালের সর্বশেষ জাতীয় শিশুশ্রম জরিপের তথ্য ভরসা। বিবিএসের ওই জরিপ বলছে, ১৭ লাখ শিশু পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। তাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই নিয়োজিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এ ছাড়া ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে সব মিলিয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে এক ঘণ্টার কর্মে নিয়োজিত থাকে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু, করোনার এ সময়ে যা আরও বেড়েছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া নিষিদ্ধ। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কাজে নেয়া গেলেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া যাবে না। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুসারে, ৫-১৮ বছরের শিশু কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫-১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই।

সরকার ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশন-১৮২ অনুসমর্থন করে। সরকারের অঙ্গীকার ছিল ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম শূন্যে নামিয়ে আনার। কিন্তু সে মেয়াদ পার হয়েছে আরও প্রায় ৫ বছর আগে। আইএলও ২০২৫ সালের মধ্যে তা নিরসন করতে চায়। এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের একই লক্ষ্য থাকলেও অগ্রগতি কম।

অনেক উদ্যোগ, ফল কম

আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশ থেকে শুধু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমই নয়, সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন হওয়ার কথা। কিন্তু শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, সে কাজের খুব একটা অগ্রগতি আসেনি।

মন্ত্রণালয় বলছে: দেশে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০’ হয়েছে, ‘জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন’ করা হয়েছে; এ ছাড়া ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ কাউন্সিল’, ‘বিভাগীয় শিশুশ্রম কল্যাণ কাউন্সিল’, ‘জেলা শিশুশ্রম পরিবীক্ষণ কমিটি’, ‘উপজেলা শিশুশ্রম পরিবীক্ষণ কমিটি’, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’ এবং সচেতনামূলক বহু কর্মশালাও করা হয়েছে।

কিন্তু গত দুই দশকে মাত্র ১ লাখ শিশুকে শ্রমের বাইরের নেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কয়টি শিশু শ্রম ছেড়েছে, তার হিসাব নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।

মন্ত্রণালয় বলছে, শিশুশ্রম নিরসনে চার পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম নিরসন’ প্রকল্পের দুই পর্যায়ে ৪০ হাজার শিশুকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পে ৫০ হাজার শিশুকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। চতুর্থ পর্যায়ে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ লাখ শিশুকে শ্রম থেকে প্রত্যাহারের লক্ষ্য নেয়া হয়। ২০২০ সালের মধ্যে সে কাজ হওয়ার কথা ছিল। শর্তসাপেক্ষে এ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বেড়েছে।

চতুর্থ পর্যায়ের প্রকল্পের আওতায় এক লাখ শিশুকে ছয় মাস মেয়াদি উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাস মেয়াদি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের একটি প্রস্তাব গত বুধবার অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়। এতে ব্যয় হবে ১৬০ কোটি টাকা।

শিশুশ্রম নিরসনে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব কে এম আব্দুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ২০১০ সালের নীতিমালার আলোকে সরকার অ্যাকশন প্লান নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ঝূঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন করা হবে। আগের ৬টি খাত এবং এ বছর দুটিসহ মোট আট খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে। চলমান প্রকল্পের আওতায় ১৪ জেলায় কাজ করা হবে।

তিনি বলেন, ‘তবে এটা শুধু এক মিনিস্ট্রির কাজ না, আমরা, মহিলা ও শিশু, শিক্ষাসহ অনেকগুলো মিনিস্ট্রির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়।’

শিশুশ্রমে কত শিশু নিয়েজিত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সঠিক সংখ্যা জানা নেই। কারণ সর্বশেষ জরিপ ২০১৩ সালের। তখন ১.৭ মিলিয়ন শিশু পূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যাটা কমে গেছে নিশ্চয়ই। আমরা সামনের বছর একটা সার্ভে করব, তখন দেখব আমাদের প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সংখ্যা কত আছে।’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে বলে জানিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়।

৩৮ কাজে ঝঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নয়

ওয়েল্ডিং, মোটর ওয়ার্কশপ, যানবাহনের হেলপার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, জাহাজ ভাঙা, বিড়ি-তামাক কারখানা, নির্মাণকাজ, ইটভাটা, পাথর ভাঙা, অটোমোবাইল স্টেশন, অ্যালুমিনিয়াম, বর্জ্য অপসারণ, কাচ, সাবান, চামড়ার কারখানা, বিস্কুট কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ ৩৮টি খাতে শিশুদের শ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে প্রথমে জাহাজ ভাঙা শিল্প, ট্যানারি ও চামড়াজাত শিল্প, সিল্ক, কাচ এবং সিরামিক শিল্পকে শিশুশ্রম মুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে।

জিএসপিতেও ঝুঁকি রয়েছে

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুশ্রম বন্ধ না হলে এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তীতেও জটিলতায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে আইএলও কনভেনশনে ১৩৮ বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আর বাংলাদেশ এলসিডির সুবিধা পাবে না। তখন জিএসপি প্লাস সুবিধা ছাড়া অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপে এ দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। তাই এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসারে নির্দিষ্ট বয়সের নিচে কোনো শিশু শ্রমে থাকতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও এতে স্বাক্ষর করেনি। তবে সরকার এর শর্ত পরিপালনে চেষ্টা করছে। কারণ, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মার্কেটে অ্যাকসেস পেতে হলে এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে হবে। তার জন্য অতি দ্রুত শিশুশ্রম উঠিয়ে ফেলতে হবে। কারণ কনভেনশন স্বাক্ষর করা মানে আইনগতভাবে তা মেনে চলতে বাধ্য থাকা।

মহামারিতে বিশ্বে বেড়েছে শিশুশ্রম

করোনার শুরুতে গত বছর ইউনিসেফ ও আইএলও আশঙ্কা করেছিল করোনাভাইসের কারণে শ্রম দিতে বাধ্য হবে বিশ্বের লাখ লাখ শিশু।

বৃহস্পতিবার সংস্থা দুটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শুরুতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। চার বছরে শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৮৪ লাখ। ২০২০ সালের শুরুতে ৭ কোটি ৯০ লাখ শিশু বিপজ্জনক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যা চার বছর আগের তুলনায় ৬৫ লাখ বেশি।

যদি দারিদ্র্যের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে প্রায় ৫ কোটি শিশু আগামী দুই বছরে শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতি ১০টি শিশুর একটি শিশুশ্রমে যুক্ত।

আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, ‘নতুন এই হিসাব একটি সতর্ক সংকেত। যখন নতুন একটি প্রজন্মের শিশুদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, তখন আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি এবং আমাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই অবস্থাকে বদলে দিতে এবং দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের চক্র ভেঙে দিতে নতুন প্রতিশ্রুতি ও শক্তির সম্মিলন ঘটানোর এখনই সময়।’

এ বিভাগের আরো খবর