মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো শুরুতে একটু আপত্তি তুললেও ভাসানচর ঘুরে দেখে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোসহ অন্যান্য এনজিও সেখানে কাজ শুরু করতে রাজি হয়েছে।
নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. মোহসীন।
গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অন্তত ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি, পররাষ্ট্রসচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিবসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
ওই বৈঠকে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাসানচরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জানান, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাসের উপযোগী ব্যবস্থাসহ সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। ভাসানচরের উন্নত পরিবেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব বলেন, ‘ভাসানচর নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ইউএনএইচসিআর-প্রধানও সেই বৈঠকে ছিলেন। তারা একমত, কক্সবাজারে ইউএন সিস্টেম যেভাবে কাজ করেছে, তারা ভাসানচরে কাজ করবে।’
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো ভাসানচরে কার্যক্রম শুরু করার তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় সচিবের কাছে। তিনি বলেন, ‘ইউএন হলো ম্যান্ডেট। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এ ধরনের শরণার্থী যদি হয়, তারাই লুক আফটার করবে। ইউএন গেলে অবশ্যই আমাদের জন্য সুবিধা। রোহিঙ্গাদের খাদ্যের চিন্তা করতে হবে না। পুরো ম্যানেজমেন্ট ইউএন করবে। আমরা তাদের সহযোগিতা করব।’
বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিবকে সভাপতি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়কে (ট্রিপল আরসি) নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৈঠকে যোগ দেয়া কূটনীতিক ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা ভাসানচর নিয়ে বেশ প্রশংসা করেছেন বলেও জানান সচিব। তিনি বলেন, ‘তারা বলেছেন, পৃথিবীর যেখানে যেখানে শরণার্থী আছে, তারা সেখানে এটিকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করবেন যে বাংলাদেশে যারা শরণার্থী আছে, যারা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ কী করেছে। প্রত্যেক অ্যাম্বাসেডর একই কথা বলেছেন।’
বৈঠকে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও সংস্থার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের জীবিকার সংস্থানের সুযোগ তৈরির ওপরও জোর দিয়েছেন বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব।
তিনি বলেন, ‘যাতে শরণার্থীরা ব্যস্ত থাকেন, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা নিচ্ছি, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু এনজিও এগিয়ে এসেছে। আমরা লাইভলিহুডের ব্যবস্থা করব, যাতে খাবারের পরেও তাদের ব্যস্ততা থাকে। কিছু অর্থ যেন তারা পায়।’
ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের সেলাই কাজসহ হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সাত সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হলো, সেই কমিটির কাজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় ওই কমিটির প্রধান মো. মোহসীনের কাছে। তিনি বলেন, ‘এই কমিটির কাজ হলো ইউএন-এ যারা জড়িত, ডব্লিউএফপি দেবে খাদ্য, ইউনিসেফ দেবে শিক্ষা– এ রকম যারা তাদের সঙ্গে বসে অপারেটিং সিস্টেমটা তৈরি করা। কীভাবে তারা যাবেন, কবে থেকে কাজ শুরু হবে, কখন থেকে যাবে– এসব ঠিক করা।’
মো. মোহসীন জানান, খুব দ্রুত বৈঠকে বসতে চান তারা। তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আগামী বৃহস্পতিবার একটি সভা হবে। সেখানে ইউএনএইচসিআর থাকবে। অপরাশেন করতে গেলে কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা আশা করছি, ইউএনএইচসিআর বা ইউএন ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করবে।
‘আগামী বৃহস্পতিবার প্রথম সভা দিয়েছি। ইউএন-এর যারা আছে, তারাসহ সাত সদস্যের কমিটির প্রথম সভা হবে। আশা করি, দু-একটি সভার পরেই তারা মাঠে কাজ শুরু করে দেবে।’
কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নেয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে দেখা দেয় নানা সামাজিক সমস্যা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এক লাখ রোহিঙ্গাকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে ১ লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কয়েক ধাপে ভাসানচরে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ৮৫৯ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে জানান সচিব।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় আশ্রয় নেয়া মোট রোহিঙ্গা শরণার্থী ১১ লাখের ওপরে।
ত্রাণসচিব বলেন, ‘আমরা ১ লাখ নিয়ে যাব। আশা করছি, এই সভাগুলো হয়ে যাওয়ার পরে আবহাওয়া একটু অনুকূলে এলে আমরা নিয়ে যাওয়া শুরু করব।’
সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আরও ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর করতে হবে। এ জন্য কত দিন সময় লাগতে পারে, জানতে চাওয়া হলে মো. মোহসীন বলেন, ‘এটা তো ধাপে ধাপে হবে। একবারে বলা যাবে না। প্রথমে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে আনা, সেখান থেকে আবার নিয়ে যাওয়া। আমরা চেষ্টা করব, নেক্সট ডিসেম্বর, জানুয়ারির মধ্যে তাদের নিয়ে যেতে।’
সরকারের অনুমতি ছাড়া ভাসানচরে সাধারণ মানুষের আনাগোনা ও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ভাসানচরের তত্ত্বাবধানে কারা আছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ট্রিপল আরসি তত্ত্বাবধান করছে।
‘আর প্রকল্পটা যেহেতু নেভি (নৌবাহিনী) বাস্তবায়ন করেছে, এ জন্য নেভির লোকজন সেই প্রকল্পটা দেখভাল করে। কিন্তু পুরোটা সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করছে। এখন যে খাবার এবং নন-ফুড আইটেম দিচ্ছে, তারা এনজিও। ৩০টার মতো এনজিও আমরা পেয়েছি, ইন্টারন্যাশনাল এনজিও।’
ভাসানচরে কাজ করছে ৪৯টি এনজিও
জাতিসংঘ এখনও যুক্ত না হলেও ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও শিক্ষাসহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে এনজিও খাত।
এনজি ব্যুরো জানিয়েছে, বর্তমানে ৫৩টি দেশি-বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করতে নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি এনজিও এখনও কী প্রকল্পে কাজ করতে চায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরেনি। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কাজ করছে ৪৯টি এনজিও।
এনজিও ব্যুরোর উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম বলেন, ‘ভাসানচরে এনজিও সহায়তা কার্যক্রম বাড়ছে। মূলত খাদ্য, শিক্ষাসহ কয়েকটি খাতে ব্যয় করছে বেশ কয়েকটি এনজিও সংস্থা। তবে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট এনজিওই বেশি।’
সম্পৃক্ততা এবং সহায়তা
এনজিও ব্যুরো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে কাজ করে ১৯টি এনজিও। ৩০ প্রকল্পে তারা ব্যয় করে ১২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে দেশি ১৪ এনজিও ২৫ প্রকল্পে ব্যয় করে ৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আর বিদেশি পাঁচটি এনজিও পাঁচটি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাসানচরে বাড়তে থাকে এনজিওদের কার্যক্রম। গত মার্চ শেষে সহায়তা করা এনজিও সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০টি। প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে হয় ৭৩টি। পাশাপাশি বাড়ে সহায়তার পরিমাণও। মার্চে দেশি ৩০টি এনজিও ৬২ প্রকল্পে ব্যয় করে ১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর বিদেশি ১০ এনজিও ১১ প্রকল্পে ব্যয় করে ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
মার্চের পর গত তিন মাসে নতুন যুক্ত হয় আরও ১৩টি এনজিও। বর্তমানে ৪৯টি এনজিও ৯০ প্রকল্পে সহায়তা কাজ পরিচালনা করছে। এসব সংস্থা ব্যয় করেছে ৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশি অর্থায়নের ২৯টি এনজিও ৩৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। ৫৬টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে এ অর্থ। আর ২০টি এনজিও নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করেছে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৩৪টি প্রকল্পে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
যেসব খাতে সহায়তা
ভাসানচরে অবকাঠামো থাকায় এ খাতে এনজিওগুলোর কোনো ব্যয় করতে হচ্ছে না। তবে সহায়তার সবচেয়ে বেশি ব্যয় গেছে খাদ্য সংগ্রহে।
জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৯ হাজার ১৭০ কেজি চাল, ৫ হাজার ৯০৯ কেজি ডাল, ২ হাজার ৯৫৯ লিটার তেল, ৪ হাজার ৫ কেজি লবণ বিতরণ করা হয়।
এ ছাড়া ৪ হাজার ১০৫ কেজি চিনি, ৫ হাজার ৪০২ কেজি পেঁয়াজ, ৮৫১ কেজি রসুন, আলু ৯ হাজার ১১৫ কেজি, আটা ৩ হাজার ৪০৫ কেজি, ডিম দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার পিস।
এ ক্ষেত্রে তৈরি খাবার বা শুকনা খাবারে ব্যয় হয় ১৭ লাখ টাকা। ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীতে ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। ভাসানচরে ১৬ হাজার ১৫২টি শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এলপিজি গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ১ হাজার ৩৮৭ সিলিন্ডার। এ ছাড়া শিক্ষা, মাছ চাষসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণেও ব্যয় হচ্ছে অর্থ।