বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে যে কয়েকটি আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো ছিষট্টির ছয় দফা আন্দোলন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে বীজ বুনেছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফা। একে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। সোমবার সেই ছয় দফা আন্দোলনের ৫৫তম বার্ষিকী।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের সব বিরোধী দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সম্মেলনে অংশ নেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সম্মেলনে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি আগ্রাসন ও শোষণ রুখতে তিনি ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি।
১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে এসে দেশব্যাপী শুরু করেন ছয় দফার পক্ষে প্রচারাভিযান। বাংলার আনাচকানাচে সফর করে তুলে ধরেন দাবির যৌক্তিকতা। তার এই দাবির পক্ষে সে সময় সারা দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে।
এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৭ জুন দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। হরতাল চলাকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় জান্তা সরকারের পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর। এতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে শহীদ হন মনু মিয়া, সফিক ও শামসুল হকসহ ১১ জন। এ হত্যাকাণ্ডের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ফুঁসে ওঠে বাংলার জনগণ। স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে আন্দোলন রূপ নেয় তীব্র গণ-আন্দোলনে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় এই গণ-আন্দোলনেরই ফসল।
ছয় দফার সেই আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে প্রতিবছরের ৭ জুন পালিত হয়ে আসছে ছয় দফা দিবস হিসেবে।
যা ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায়
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা করা ছয় দফার প্রথম দফায় বলা হয়, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সব নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলো থাকবে সার্বভৌমত্ব।
দ্বিতীয় দফায় প্রস্তাব করা হয়, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবল দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুটি বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট সব বিষয় থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
তৃতীয় দফায় পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রাব্যবস্থার কথা প্রস্তাব করা হয়। পৃথক হলেও এগুলো হবে সহজে বিনিময়যোগ্য। দুই অংশের জন্য দুটি স্টেট ব্যাংক গঠনেরও প্রস্তাব করা হয় এতে।
চতুর্থ দফায় বলা হয়, সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ি রেভিনিউয়ের নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে।
পঞ্চম দফায় বলা হয়, দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হিসাব থাকবে আলাদা। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
ষষ্ঠ ও শেষ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপনের দাবিও জানান বঙ্গবন্ধু।
ছয় দফা আন্দোলনের স্মৃতিচারণা করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমি। এর মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার চেতনায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়। ৭ জুন ছয় দফার জন্য যে প্রথম রক্ত ঝরে, এটা সবাই মনে করে স্বাধীনতার জন্য প্রথম রক্তদান।
‘পাকিস্তান সৃষ্টি থেকেই পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন বাঙালি কোনো দিন স্বাধিকার ভোগ করতে পারেনি। একধরনের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ পূর্ব বাংলার ওপর চাপিয়ে রাখা হয়েছিল এবং শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। বিষয়টি অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু মুক্তির দিশারি হিসেবে জনগণের সামনে ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল গভর্নমেন্ট এবং যেখানে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটের ভিত্তিতে পার্লামেন্টারি ফরম অব গভর্নমেন্ট। তিনি শোষণ বন্ধে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল দুই অর্থনীতি। যদিও একটি মুদ্রা থাকতে পারে অবাধ বিনিময়যোগ্য কিন্তু পাচার বন্ধে সক্রিয় কিছু আইনকানুন থাকতে হবে।
‘আরেকটি কথা তিনি বলেছিলেন ’৬৫ সালের যুদ্ধের আলোকে যে, এটা ছিল প্রমাণিত বাংলাদেশ ছিল অরক্ষিত। তাই এখানে নৌ হেডকোয়ার্টারসহ প্যারামিলিশিয়া গঠনের কথা ছয় দফায় ছিল। আরেকটি বিষয় ছিল ট্যাক্স ধার্য ও খরচের ক্ষমতা সম্পূর্ণ প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তুলনামূলকভাবে সেখানে দেয়া হবে। এগুলো পাকিস্তানিরা কখনোই মেনে নেয়নি। তারা মনে করত, এটা বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি।’
এদিকে ছয় দফা দিবস হিসেবে নানা কর্মসূচি আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এর মধ্যে সোমবার সকালে সূর্যোদয়ের ক্ষণে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারা দেশে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ।