মূল আসামির পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে বা যেকোনো কৌশলে নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে রাখার ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এ মন্তব্য করে।
চট্টগ্রামের একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি কুলসুম আক্তারের পরিবর্তে নিরপরাধ মিনু আক্তারের জেল খাটার বিষয়ে শুনানির সময় আদালত এ মন্তব্য করে।
আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ।
শুনানিতে জেলে থাকা নিরপরাধ মিনুর পুরো ঘটনা তুলে ধরে শিশির মনির জানান, গত দুই বছরে দেশে এমন ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। একজনের নামে আরেকজন জেলে থেকেছেন।
তিনি বলেন, আসল আসামি শনাক্তে অনেক পদ্ধতি আছে। আইবলিং পদ্ধতি আছে; এতে শনাক্ত করলে কোনো ভুল হবে না।
মিনুর ঘটনার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে জানিয়ে বিষয়টি তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা দাবি করেন তিনি।
ওই সময় বিচারপতি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এভাবে যদি রিয়েল (আসল) কালপ্রিট (দোষী) অর্থের বিনিময়ে হোক অথবা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্য নিরপরাধ লোককে জেলের মধ্যে আটক রাখে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’
পরে আদালত আগামীকাল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।
শুনানিতে আইনজীবী শিশিরের সঙ্গে একমত হন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. বশির উল্লাহও। তিনি বলেন, ‘আমরাও চাই দোষীদের শাস্তি হোক, নিরাপদ কেউ যাতে জেলে না থাকে।’
হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামির বদলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই বছর ৯ মাস ধরে জেল খাটছেন মিনু।
কারাগারে বালাম বই খুঁজতে গিয়ে বিষয়টি উঠে আসে। এরপর গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রামের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ।
আদালতে হাজির করা হলে মিনু নতুন করে জবানবন্দি দেন। সেই সঙ্গে মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানোর নির্দেশ দেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঞা।
এক দিন পরই ২৪ মার্চ নথি হাইকোর্টে আসে। পরে বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।
যেভাবে কারাগারে গেলেন মিনু
চট্টগ্রাম আদালতে দেয়া নতুন জবানবন্দিতে মিনু জানান, সময়টি ছিল ২০১৮ সালের রমজান মাস। ইফতারি দেয়ার কথা বলে কুলসুম ও মর্জিনা নামের দুজন আদালতে মিনুকে নিয়ে যান। মিনুকে বলা হয়েছিল ‘কুলসুম’ নাম ডাকা হলে তিনি (মিনু) যেন হাত তোলেন। সে অনুযায়ী হাত তোলার পর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘কুলসুম’ হিসেবে চিহ্নিত করে কারাগারে পাঠায়।
মিনুকে এভাবে কৌশলে অপরাধী সাজানো কুলসুম হত্যা মামলার আসামি। তার পুরো নাম কুলসুম আক্তার কুলসুমি।
২০০৬ সালের জুলাইয়ে নগরীর কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি আমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পারভীন নামের এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে, পারভীনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের জন্য গাছে ঝুলিয়ে রাখেন কুলসুম।
২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর কুলসুমকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এক বছর তিন মাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
২০১৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন তখনকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক নুরুল ইসলাম। তাতে কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। সে সময় কুলসুম পলাতক ছিলেন।
পরে আইনজীবী নাছির উদ্দীনের মাধ্যমে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুম আত্মসমর্পণ করতে চান। আত্মসমর্পণের দিনই মিনুকে কুলসুম সাজিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। তখন থেকেই কারাগারে আছেন মিনু।