বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘চোক্ষের সামনে ছেলেরে পুইড়া মরতে দেখছি’

  •    
  • ৩ জুন, ২০২১ ১৭:৪২

মামুন বলেন, ‘আমার ছেলে প্রথমে দুইটা চিক্ষার (চিৎকার) দিল। তিন চিক্ষারের সময় আর নাই। আমার এত বড় ছেলে চোক্ষের সামনে পুইড়া কালা হইয়া মইরা গেছিল। আগুন দাউ দাউ কইরা জ্বলতে শুরু করছে। চোক্ষের সামনে ছেলেরে পুইড়া মরতে দেখছি। দেইখা আমি দৌড় দিয়া দোকান থেইকা বাইরাইয়া গেছিলাম। এই যে দ্যাহেন আমার শরীর ভরা পোড়ার দাগ।’

‘আগুন দাউ দাউ কইরা জ্বলতে শুরু করছে। চোক্ষের (চোখের) সামনে ছেলেরে পুইড়া মরতে দেখছি। দেইখা আমি দৌড় দিয়া দোকান থেইকা বাইরাইয়া গেছিলাম। এই যে দ্যাহেন আমার শরীর ভরা পোড়ার দাগ।’

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টার দিকে লাগা আগুনে ৭ বছরের ছেলে বৈশাখের পুড়ে মারা যাওয়ার দৃশ্য চোখ ছলছল অবস্থায় নিউজবাংলাকে জানাচ্ছিলেন তার বাবা মো. মামুন।

ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মামুনের ছেলের মতো পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। এক ভবনেই মারা যান বিয়ের অতিথিসহ ৪১ জন। ভবনটির পাশেই ছিল মামুনের ফল আর সবজির দোকান।

১১ বছর আগের সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মো. মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি তহন এই দোকানে ফল আর সবজি বিক্রি করতাম। আগুন লাগনের সময় আমি আর আমার ৭ বছরের ছেলে বৈশাখ দোকানে আছিলাম। ওই যে আমার দোকানের সামনে ব্যানারে ছবি দেখতাছেন, ওইডা আমার ছেলে। এক জায়গায় আমরা দুইজন আছিলাম। আমি কীভাবে বাঁচলাম এইডা একমাত্র আল্লায় যানে।’

চোখের সামনে ছেলের মৃত্যুর সে ঘটনা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মামুন। একটা পর্যায়ে আবার বলা শুরু করেন।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে পুড়ে যাওয়া এলাকা। ছবি- সাইফুল ইসলাম

মো. মামুন বলেন, ‘আমার ছেলে প্রথমে দুইটা চিক্ষার (চিৎকার) দিল। তিন চিক্ষারের সময় আর নাই। আমার এত বড় ছেলে চোক্ষের সামনে পুইড়া কালা হইয়া মইরা গেছিল। আগুন দাউ দাউ কইরা জ্বলতে শুরু করছে। চোক্ষের সামনে ছেলেরে পুইড়া মরতে দেখছি। দেইখা আমি দৌড় দিয়া দোকান থেইকা বাইরাইয়া গেছিলাম। এই যে দ্যাহেন আমার শরীর ভরা পোড়ার দাগ।’

ঘটনার বর্ণনা দেয়ার একপর্যায়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার ছয় মাসও যাইতে পারে নাই আবার এই বিল্ডিং প্লাস্টার কইরা ভাড়া দিছে। বাড়ির মালিকের উন্নয়ন হইছে, মাগার আমাগো উন্নয়ন হয় নাই। এই বিল্ডিং আগে আছিল পাঁচতলা, অহন হইছে ছয়তলা। ওই গুদাম অহন ডেকোরেটরের দোকানরে ভাড়া দিছে।’

ঘটনার সময় ৪৩ নম্বর ভবনটির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্না এবং পাশের ভবনে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। আর ভবনটির সামনে রান্না চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে যায়। একটা পর্যায়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির নিচতলায় থাকা একই পরিবারের ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া সামনের ৫৫ নম্বর ভবনের ছয়জন এবং বিয়ের বাড়ি লাগোয়া আরেক ভবনের আরও ছয়জন ঘটনাস্থলেই মারা যান।

বিয়ের সাজের জন্য পারলারে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান ওই তিন কন্যা। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে নিয়ে তাদের বিয়ের আয়োজন করেন। তিন মেয়ের স্বামীদের চাকরিও দেন প্রধানমন্ত্রী।

এই তিন কন্যার একজন আসমা। নিমতলী ট্র্যাজেডির ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে বৃহস্পতিবার। এ জন্য অনেকের মতো আসমার স্বামী মো. আলমগীর দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন নিহতদের স্মরণ করতে ও শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন মিরপুরে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ফ্ল্যাটে।

নিউজবাংলাকে মো. আলমগীর বলেন, ‘আল্লার রহমতে এখন ভালো আছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তিন মেয়ের এক মেয়ে আসমার জামাই আমি। আমাদের তিন সন্তান। আমি বড় ও মেজো ছেলেকে নিয়ে এসেছি।’

নিমতলীতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে বৃহস্পতিবার ফুল দিয়ে নিহতদের স্মরণ করেন অনেকে । ছবি- সাইফুল ইসলাম

বিভীষিকাময় সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘৩ তারিখে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। পরে এমন দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আসমার মা, নানু, ভাতিঝিসহ তাদের অনেক আত্মীয় মারা গেছিল। আসমার বাবা, আমার শ্বশুর ভালো আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন।’

পাশের দোতলা ভবনের মালিক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ওই বিল্ডিংয়ের ভেতরে তহন কেমিক্যালের গোডাউন আছিল। গোডাউনের আগুন আইসা আমার বিল্ডিংয়ে লাগে। আমার ভাড়াটিয়া ও আত্মীয়স্বজন মিইল্লা মোট ১১ জন মারা গেছিল। বউ গেছিল ভাইয়ের বাসায়। আমি আর পোলারা আছিলাম বাইরে। তাই বাইচা গেছিলাম।’

নিমতলী ট্র্যাজেডির ১১ বছর হয়ে গেলেও পুরান ঢাকার এই এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন পুরোপুরি সরেনি। ৪৩ নম্বর বাড়ির সামনের সেই বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার দুটি এখনো আছে। বিপরীত পাশের ভবনের সামনে অগোছালোভাবে ঝুলছে ইলেকট্রিকসহ নানা ধরনের তার। নিমতলীর এই গলিতে এখন কেমিক্যালের গোডাউন না থাকলেও পাশের গলিতেই আছে।

৪৩ নম্বর বাড়ির মালিক তিন ভাই। ভয়াবহ ওই আগুনে তিন ভাই বাদে পরিবারের সবাই মারা যান। পরে তিন ভাই আবার বিয়ে করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় মো. গোলজার। তার যমজ দুই ছেলের মৃত্যু হয় সেদিন। নতুন সংসারে এক বছরের ব্যবধানে দুটি ছেলে হয়েছে তার। মেজো ভাইয়ের নতুন সংসারে এক ছেলে এবং ছোট ভাইয়ের এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সকালে ওই ভবনে গিয়ে তিন ভাইয়ের কাউকেই পাওয়া যায়নি। তারা তখন যাচ্ছিলেন আজিমপুর কবরস্থানে। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কথা হয় মো. গোলজারের সঙ্গে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখন আজিমপুর কবরস্থানে যাচ্ছি কবর জিয়ারত করতে। পরিবারের মানুষ হারানো শোক নিয়ে কোনোমতে দিন কেটে যাচ্ছে। এই ঘটনায় আমার পরিবারের ১১ জন মারা যায়। আমার মা, চাচি, তিন ভাইয়ের তিন বউ ও আমাদের তিন ভাইয়ের দুইটা করে বাচ্চা মারা যায়। পরবর্তীতে আমরা তিন ভাই আবার বিয়ে করি। নিচতলায় এখন একটা ডেকোরেটর ও একটা মুদি দোকান ভাড়া দিয়েছি।’

নিমতলীর সেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এই ভবন থেকে । বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে ছিল এমন চিত্র। ছবি- সাইফুল ইসলাম

দিবসের কর্মসূচি

প্রতিবছরের মতো এবারও পুরান ঢাকার নবাবকাটারার নিমতলীতে নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে। ছিল দোয়া মাহফিলের আয়োজন। সকাল থেকে দলে দলে মানুষ এসে শ্রদ্ধা জানান স্মৃতিস্তম্ভে। সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে নিহত ও তাদের পরিবারের জন্য দোয়া করা হয়।

পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম ও দোকান অপসারণের দাবিতে বেলা ১১টার দিকে নিমতলী ছাতা মসজিদের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।

এ বিভাগের আরো খবর