একই দিনের মধ্যে অন্তত পাঁচবার কেঁপে ওঠে সিলেট। তাও আবার দুই ঘণ্টার মধ্যে। এই অঞ্চল তো বটেই, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক সারা দেশেই।
তিন প্লেটের সংযোগস্থল হওয়ায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশের ডাউকি ফল্ট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূত্বকে জমে থাকা হাজার বছরের সঞ্চিত শক্তি রূপ নেয় ভূমিকম্পে। এই শক্তি একবারে বের হলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে- এমন কথা বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন।
তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতি অভাবনীয়ই বলা যায়। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আগাম তথ্য দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি। আর বড় ধরনের ভূমিকম্পের যে ক্ষয়ক্ষতি, সেটি সব সময়ই মাথায় রাখতে হয়।
সময় না দিয়ে সিলেটের বারবার এই কেঁপে ওঠার পর বলাবলি হচ্ছে, এটি ভয়ানক কোনো পরিণতির পূর্বাভাস কি না।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার মনে করেন, ভূ-অভ্যন্তরে সঞ্চিত শক্তি সামান্য একটু একটু করে বের হয়ে আসা কিছুটা হলেও স্বস্তির। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, এই শক্তি যদি একবারে বের হয়ে আসে, তাহলে বাংলাদেশের বিশেষ করে জনবহুল ঢাকার জন্য খুবই বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি করবে।’
তিনি জানান, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় অবস্থান করছে। ইন্ডিয়া এবং বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের নিচ দিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর ও মেঘনা নদী বরাবর এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তরে হিমালয় পাদদেশও আছে একটি সংযোগস্থল। এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার
সিলেটের ভূমিকম্পের স্থান ও প্রধান দুটি ভূমিকম্পের উৎসের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, শিলং মালভূমি যেটা বলা হয়, সেটি ক্ষুদ্র একটা প্লেট। এটি ডাউকি ফল্ট, সেটাও একটা প্লেট বাউন্ডারি। সিলেটের ভূমিকম্প হয়েছে ডাউকি ফল্টে।
হাজার বছর ধরে ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘সেখানে আমাদের দেড় যুগের গবেষণা বলছে, আমাদের প্রধান দুটি উৎস রয়েছে বিপজ্জনক ভূমিকম্পের। একটা হচ্ছে ডাউকি ফল্ট, আরেকটা হচ্ছে সিলেট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল।
‘ডাউকি ফল্ট ও চট্টগ্রামের এখানে ৫০০ থেকে হাজার বছর সময়ে ভূত্বকে যে শক্তি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে, সেই শক্তি তো বের হতেই হবে। আজ হোক আর কাল হোক, এই শক্তি বের হতেই হবে, এর কোনো বিকল্প উপায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘এই পুরো শক্তি আংশিকভাবে বের হলে আমার কিছুটা নিরাপদে থাকব। সাধারণত সঞ্চিত যে শক্তি থাকে, তার ৫০ ভাগ যদি একবারে বের হয়, সেটা বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে যাবে।’
একবারে বের হলে পরিস্থিতি হতো ভয়ানক
অধ্যাপক আখতার জানান, যে পরিমাণ শক্তি আমাদের ভূগর্ভে জমা রয়েছে, সেটি একবারে বের হলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।
তবে সেটা না হয়ে ছোট মাত্রার এসব ভূমিকম্প পরিবেশে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন তিনি।
বড় ভূমিকম্প হলে তার প্রভাব কী হতে পারে, সেটি তুলে ধরতে গিয়ে এই ভূতত্ত্ববিদ উনিশ শতকের শেষ দিকের ভূমিকম্পের কথা তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এখনকার যমুনা নদীতে প্লাবিত হচ্ছে।
ভূমিকম্প মোকাবিলায় কী প্রস্তুতি জরুরি
অধ্যাপক আখতার বলেন, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক রকম আছে। বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে। যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো ভেঙে ফেলা উচিত।
সিলেটের এই ঘটনার আলোকে মহড়ার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘মহড়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে সঠিক জায়গায় অবস্থান করার ব্যাপারে জ্ঞান দেয়া যায়। এ ছাড়া তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা যায়।’
তিনি বলেন, প্রতিবছর যদি একবার-দুবার মহড়া দেয়া হতো, তাহলে আজকে এই ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে মানুষ আতঙ্কিত হতো না।
রিখটার স্কেলে ধরা পড়েছে চারটি
সিলেটবাসী ভূমিকম্পের কারণে পাঁচবার বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেও আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ধরা পড়েছে চারটি।
এর কারণ কী?
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ‘ছোট ছোট আরও কিছু ভূমিকম্প হয়েছিল। যেগুলো রিখটার স্কেলে কম থাকার কারণে ধরা পড়েনি।’
এতবার কেন কাঁপল?
বজলুর রশিদ বলেন, ‘একটা ভূমিকম্প হওয়ার পরে অনেক ভূমিকম্প হতে পারে। এটাকে আফটার শক বলা হয়। নেপালে এমনও হয়, ২০০ থেকে ৩০০ বার টানা দুই দিন ধরে ভূমিকম্প হয়।
সিলেটের ভূমিকম্প নিয়ে কি আশঙ্কার কারণ আছে?
বজুলর বলেন, ‘এই কয়েকটা ভূমিকম্প হওয়ার কারণে যে আরেকটা বড় ভূমিকম্প আসছে, এটা বলার কোনো কারণ নেই। এ রকম কোনো রিসার্চেও পাওয়া যায়নি। অনেক সময় মাটির নিচে গ্যাস সন্ধানসহ কোন ধরনের পরীক্ষা করার সময়ও এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে।’
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের মতো এই আবহাওয়াবিদও সতর্ক করে দেন যে, সিলেট উচ্চ ঝুঁকিতে আছে।
তিনি বলেন, ‘সিলেট যেহেতু একটা হাইরিস্ক জোন, অর্থাৎ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, সেহেতু ধরে নিতে হবে ওখানে ছোট-বড় ভূমিকম্প হবে।
‘সিলেট হচ্ছে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থল, সেহেতু যেকোনো সময় এখানে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু কত দিন পরপর হবে এটা বলা যাবে না।’