করোনা মহামারির কারণে আয় কমে যারা নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছেন, তাদের সিংহভাগ সরকারি সহায়তার বাইরে রয়ে গেছে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এক জরিপের ভিত্তিতে বলেছে, এ ধরনের মানুষদের ৭৭ শতাংশের কাছেই সরকারি সহায়তা পৌঁছেনি।
আবার যারা হতদরিদ্র, তাদের একটি বড় অংশও সহায়তা পাননি। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে তারা জানতেনও না।
বৃহস্পতিবার সিপিডি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংলাপে এ তথ্য জানানো হয়।
সংলাপের বিষয়বস্তু ছিল ‘করোনা মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচি: কতটা কার্যকর ছিল?’
এতে জানানো হয়, করোনাকালে বিপুলসংখ্যক মানুষ যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন, তাদের নাম তালিকাভুক্ত ছিল না। এ কারণেই মূলত তারা সহায়তার বাইরে রয়ে গেছেন।
হালনাগাদ তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও করেছে সিপিডি।
তালিকা হালনাগাদ করার পরামর্শ
সিপিডির অপর বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। তিনি বলেন, এ সময় সরকার এককালীন আড়াই হাজার টাকা, ত্রাণ হিসেবে নগদ টাকা এবং চাল দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র যে ২৫ শতাংশ মানুষ, তার মধ্যে শুধু এক-চতুর্থাংশ এসব সুবিধা পেয়েছেন। তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সরকারের কোনো কর্মসূচি থেকে সহায়তা পাননি।
যাদের সহায়তা করা হয়েছে, তাদের ৪৪ শতাংশের সহায়তা পাওয়ার কথা নয় বলেও জানান তিনি।
মোস্তাফিজ বলেন, ‘সরকারি সহায়তায় উপকারভোগী চিহ্নিতকরণ ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা বেশি চোখে পড়েছে। যেমন, করোনায় আয় কমে গিয়ে, চাকরি হারিয়ে যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, এমন ৭৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কোনো সহায়তা পাননি। এসব মানুষ আগে দরিদ্র ছিলেন না। কিন্তু নতুন করে তাদের দরিদ্রের ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে যারা কোনো মধ্যমে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, তাদের একটা অংশ সহায়তা পেয়েছে।’
করোনাকালে বিভিন্ন হটলাইন সুবিধা চালু করে সরকার যে সহায়তার চেষ্টা করছে, সেটির প্রচার খুব একটা হয়নি বলেও জানান তিনি। সিপিডি জেনেছে, মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ সরকারি হটলাইন সম্পর্কে জানতেন।
অর্ধেকের বেশি মানুষ জানেন না তারা সহায়তা কোন শাখায় পেতে পারেন। তবে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন, তারা সহজেই সহায়তা পেয়েছেন।
সহায়তা কত
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানান, করোনার সময়ও মোট এক কোটি আট হাজার পরিবারকে ভিজিএফের আওতায় ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়েছে। হটলাইন নম্বর ৩৩৩ চালু করায় বিপাকে পড়া যে কারও খাদ্য সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এর বাইরে এক লাখ শিক্ষক ও এক লাখ কৃষককে পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
তবে এসব সহায়তা বিতরণের ক্ষেত্রে কিছু সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করেন প্রতিমন্ত্রী। বলেন, ‘মানুষের যে চাহিদা সে অনুযায়ী বিতরণের জন্য আমাদের সাহায্য-সুবিধা এখনো উন্নত দেশের মতো হয়নি। তাই প্রায়োরিটি হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর করোনার সময় কিছু সমস্যা থাকলেও এবার তার থেকে বেশ উন্নতি হয়েছে, আগের চেয়ে ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে।’
ত্রাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটা নির্ভুল ডাটাবেজ থাকতে হবে। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।’
সুবিধাভোগীর তালিকা করার সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির সমস্যাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘যে যে লোককে সাহায্য দিলে তার ভোট বাড়বে, তিনি তাদের বেছে নেন। তবে দেখতে হবে, যে পেয়েছেন, তিনি সত্যিকার পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কি না।’
‘মানুষের যে চাহিদা সে অনুযায়ী বিতরণের জন্য আমাদের সাহায্য-সুবিধা এখনো উন্নত দেশের মতো হয়নি। তাই প্রায়োরিটি হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর করোনার সময় কিছু সমস্যা থাকলেও এবার তার থেকে বেশ উন্নতি হয়েছে, আগের চেয়ে ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে।’
বরাদ্দ বাড়ানো, বিতরণে স্বচ্ছতার পরামর্শ
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ত্রাণকাজে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিতরণব্যবস্থাও স্বচ্ছ হতে হবে। কেউ না পেয়ে নালিশ করলে তা সহজেই সমাধান করতে হবে। এর আরও প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।’
জাতীয়ভাবে তথ্য-উপাত্তের অভাব রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এক দশকের পুরোনো তথ্য দিয়ে সরকারি কার্যক্রম চলছে। এতে বেশ সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।’
তবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ প্রদান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, স্বচ্ছতা, নজরদারি ও জবাবদিহিও বেড়েছে।
নগদ সহায়তা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত
ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক বলেন, ‘করোনার সময় নগদ সহায়তা বিতরণে সরকার যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরকে যুক্ত করার কারণে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হয়েছে।’
৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে ৩৬ লাখ পরিবারকে দুবার করে এই টাকা দেয়া হয়েছে।
নগদের এমডি বলেন, ‘আমি এটাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখি। এখানে সরকারের সাড়ে তিন শ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আগে আমরা দেখতাম, ত্রাণের চাল বা ঢেউটিন চুরির খরব সংবাদপত্রে আসত। এবার কিন্তু কোনো চুরির খরব আসেনি। কারণ, এর কোনো সুযোগই ছিল না। তবে স্থানীয় পর্যায় থেকে যে তালিকা এসেছে, সেটা নিয়ে আমার বিশেষ কিছুই বলার নেই।’
মিশুকের কথার সঙ্গে একমত হয়ে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি সহায়তা বিতরণের জন্য ব্যাংকিং পদ্ধতি ব্যবহারের বিকল্প হিসেবে এমএফএসকে ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
মোবাইল ফোন ব্যবহার করেও সহায়তা বিতরণের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তাদের এই বক্তব্যে একমত পোষণ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ত্রাণ সহায়তা বিতরণের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেন।