ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমান যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে তার গলায় চালিয়েছিলেন, তখন তার চার বন্ধু ছিলেন কার্জন হলের আড্ডায়।
১৫ মে রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে ভ্রাম্যমাণ এক ডাব বিক্রেতার দা দিয়ে নিজের গলায় পোঁচ দেন হাফিজুর। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অধিক রক্তক্ষরণের কারণে রাত ১০টা ২০ মিনিটে হাফিজ মারা যান। হাফিজের সঙ্গে সর্বশেষ আড্ডা দেয়া সেই চারজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলেই অবস্থান করছিলেন।
তাদের একজন আসিফ বাপ্পি নিউজবাংলাকে বলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র।
অন্য তিনজন হলেন ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রূদ্রদীপ রুপম অন্তু ঠাকুর, মাসুদ এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র রাফসান ।
আসিফ বাপ্পি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্জন হলে আড্ডা দিয়েছিলাম। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি শুরু হলে আমরা রসায়ন বিভাগের বারান্দায় আশ্রয় নিই। কিছুক্ষণ পর হাফিজ হঠাৎ তার নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবে বলে পাগলামি শুরু করে। আমরা সবাই মিলে তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি।
‘কিন্তু সে আমাদের কাছ থেকে দৌড়ে দোয়েল চত্বর থেকে চানখাঁরপুলের যে রোড সেদিকে পালিয়ে যায়। আমরা বাইক নিয়ে তাকে টিএসসিসহ আশপাশে খুঁজি। কিন্তু আমরা তাকে পাইনি। পরে আমরা কার্জন হলে ফিরে আসি। সেখানে প্রায় রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত আড্ডা দিই।’
বাপ্পি বলেন, ‘আড্ডার শুরু থেকেই হাফিজকে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছিল। এর মধ্যে সে ফোনে কারও সাথে ঝগড়া করছিল।’
কার্জন হলে আড্ডার সময় তারা কোনো ধরনের মাদক নেননি বলে জানান বাপ্পি। বলেন, ‘কার্জন হলে আমরা এক সাথে বসে যে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি, তখন আমরা শুধু সিগারেট, কোক, বিভিন্ন খাবারদাবার খেয়েছি।’
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও ডাবওয়ালার ভাষ্য অনুযায়ী, হাফিজ রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ডাব বিক্রেতার দা দিয়ে নিজের গলায় পোঁচ দেন। এর কিছুপর সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কার্জন হলে থাকা অবস্থায় হাফিজের ঘটনার কোনো খবর পেয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে বাপ্পি বলেন, ‘তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা ছিলাম কার্জন হলে। তাই এটা ফিল হয়নি।’
হাফিজের সঙ্গে আড্ডা দেয়া তার আরেক বন্ধু অন্তু ঠাকুরের মোবাইল নম্বর চাইলে বাপ্পি দেবেন দেবেন করেও আর দেননি।
তবে মঙ্গলবার অন্তু ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ এ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। তবে বাপ্পির বক্তব্যের সঙ্গে স্ট্যাটাসের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি ।
স্ট্যাটাসে অন্তু লিখেছেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় হাফিজ হঠাৎ বলে উঠল সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যাবে। যেদিন আসল, সেদিনই চলে যাবে এমনটা তো হওয়ার কথা না। আমি বল্লাম, কী বলিস। পরে যা, কালকে যা। আর এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে।
‘আমরা যতই বলছি বৃষ্টি থামুক, সে ততই বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হচ্ছিল। আমরা তাকে বিদায় দিলাম। সে চলেও গেল।’
তবে বাপ্পির বক্তব্য অনুসারে বিদায় নয়, সেই রাতে হাফিজ তাদের কাছ থেকে দৌড়ে পালিয়েছিলেন।
সার্বিক বিষয় জানতে অন্তু ঠাকুরকে অনেকবার মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি ধরেননি। সর্বশেষ তথ্যমতে, অন্তু ছাড়া হাফিজের সঙ্গে সেদিন আড্ডা দেয়া অন্য তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ।
ডাব বিক্রেতার ভাষ্য
তার নাম আনোয়ার হোসেন। থাকেন ঢাকার হোসেনি দালান এলাকায়। গ্রামের বাড়ি নোয়খালী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের বাইরে রাস্তার ওপর নিয়মিতই ডাব বিক্রি করেন তিনি। সেদিনও ডাব বিক্রি করছিলেন। সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হয়। আনোয়ার প্রশাসনিক ভবনের সামনের ছাউনিতে আশ্রয় নেন। বৃষ্টি সামান্য থামলে আবার দোকানে ফিরে যান।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তখন পৌনে আটটা বা আটটা বাজে। দোকানে কিছু কাস্টমার ছিল। আমি তাদের সাথে কথা বলছিলাম। একটা অচেনা ছেলে আসছে। কখন আসছে তা-ও দেখিনি । তখন অন্ধকার ছিল। তার পরনে শর্ট প্যান্ট ছিল। গায়ে কিছু ছিল না। হঠাৎ সে আমার দা নিয়ে নিজের গলায় চালিয়ে শহীদ মিনারের দিকে চলে যায়।’
এ ঘটনার পর থেকেই ডাব কাটার ওই দা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন আনোয়ার হোসেন ।
হাফিজুর দা দিয়ে নিজের গলায় পোঁচ দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার আগেই ঢাকা মেডিক্যালের বহির্বিভাগের সামনে বসে পড়েন। সে সময়ের একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যায়, খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরিহিত রক্তাক্ত হাফিজুর বহির্বিভাগের সামনের দেয়াল ঠেসে ফুটপাতে বসে আছেন।
হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ান। গলা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে ভিজে গেছে তার সম্পূর্ণ শরীর। এক পুলিশ সদস্য এসে হাত ধরে হাফিজুরকে তুলে দিচ্ছেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশায়। রিকশাচালককে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যেন হাফিজুরকে সামনে অবস্থিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় ।
নিউজবাংলার প্রতিবেদক সে স্থান ঘুরে দেখেছেন। দেখা গেছে, সেই দেয়ালে এখনও রক্তের ছাপ লেগে আছে। বহির্বিভাগের সামনে সেদিনের ঘটনা দেখেছেন বহির্বিভাগের পাশেই থাকা সোনিয়া স্টোরের কর্মচারী সবুজ।
সবুজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানের সামনে কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছিল। তখন পুরো এলাকায় পানি জমে গেছে। সেই ছেলেটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল। তাকে দেখে কে যেন বলছিল, হায় হায়, এ তো গলা কাটা। এরপর হইচই পড়ে গেলে পুলিশ আসে। আমি দোকানের ভেতর থাকার কারণে সেই ছেলেটি কোত্থেকে এসেছিল, সেটা খেয়াল করিনি।’
ঘটনার সময় কত মানুষ ছিল জানতে চাইলে সবুজ বলেন, ‘তখন খুব বেশি মানুষ জমায়েত হয়নি। কারণ, তখন বৃষ্টি হচ্ছিল।’
হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রভিত্তিক (টিএসসি) সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ।
১৫ মে থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ২৩ মে শাহবাগ থানায় এসে ছবি দেখে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ থেকে লাশ শনাক্ত করেন হাফিজুরের ভাই হাবিবুর রহমান।
এরপর এ ঘটনায় পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শিক্ষার্থীরা । ২৪ মে সহকারী প্রক্টর লিটন কুমার সাহাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘কমিটির সদস্যদের নিয়ে বসে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা দ্রুতই প্রতিবেদন দেয়ার চেষ্টা করব।’