‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ হিসেবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট এখন বিশ্বের সব দেশের জন্য বৈধ।
পাসপোর্টে ‘ইসরায়েল ছাড়া এই পাসপোর্ট বিশ্বের সব দেশের জন্য বৈধ’ (দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরায়েল) কথাটি বদলে এখন লেখা হচ্ছে, ‘এই পাসপোর্ট বিশ্বের সব দেশের জন্য বৈধ (দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড)।’
‘ইসরায়েল ছাড়া’ শব্দ দুটি বাদ পড়ার মধ্য দিয়ে ভ্রমণের জন্য সব দেশ উন্মুক্ত হয়ে গেছে বলে মনে করেন কূটনীতিক বিশ্লেষকরা। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশি নাগরিকরা ইসরায়েল ভ্রমণ করতে পারবেন না।
তাহলে কেন এই পরিবর্তন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ই-পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে এই সিদ্ধান্ত।
পাসপোর্টে কবে থেকে এ পরিবর্তন আনা হয়েছে নির্দিষ্ট করে দিন, তারিখ বলতে না পারলেও মন্ত্রী বলেন, ‘এটা অনেক দিন ধরে হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্টে তো এগুলো লেখা থাকে না। সে জন্য ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্টে যেভাবে থাকে আমরা সেভাবেই করেছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয় একই সুর। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা আমি শুনেছি। শোনার পরে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। এটা প্রায় ছয় মাস আগে নতুন পাসপোর্ট যখন অর্ডার দেয়া হয়, তখন টু মেইনটেইন স্ট্যান্ডার্ড, অনেকগুলো পাসপোর্ট তারা দেখেছেন।
দুনিয়ার কোনো পাসপোর্টে ‘এক্সসেপ্ট’-এর মতো বিষয়টি নেই দাবি করে মোমেন আরও বলেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো দেশের পাসপোর্টে এ রকম লেখা থাকে না। সে জন্য এটা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আইয়ুব চৌধুরীও বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনার আলোকে পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার স্বার্থে এটা বাদ দেয়া হয়েছে।’
ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে সমুদ্রসৈকত। ছবি: এএফপি
ওই মুহূর্তে তিনি অফিসে না থাকায় ঠিক কবে থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, সেটি নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি আইয়ুব।
তিনি বলেন, ‘এটা আগেই বাদ দেয়া হয়েছে। ইমপ্লিমেন্ট হতে তো এক বছর সময় লেগে যায়।’
আধুনিক পাসপোর্টে এসব কথা লেখা থাকা না থাকা তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না বলে দাবি করেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পাসপোর্ট আছে দুইটা। পাসপোর্ট রিড করা হয়, রিডিং পড়ে নয়। আপনি যখন ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করেন, একটা আছে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। মেশিন রিড করে। সেখানে এ ধরনের কোনো কিছু নাই।
‘আরেকটা আছে ই-পাসপোর্ট। সেটা ইলেক্ট্রনিক চিপ থেকে রিড করে। সেখানেও নেই। আইসিএও নিয়ম অনুযায়ী, যেগুলো থাকার কথা সেগুলো আছে। আপনার পরিচয়, আপনার বায়োমেট্রিক-সেগুলো আছে।’
পাসপোর্টে অনেক কিছু লেখা থাকলেও সেগুলো দেখা হয় না বলে দাবি করেন তিনি।
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকরা ইসরায়েলে যেতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না। এটার সঙ্গে ইসরায়েলে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।’
ভিন্নমত কূটনীতিকদের
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কূটনীতি বিশ্লেষক তৌহিদ হোসেন বলেন, এই পরিবর্তনের ফলে পাসপোর্ট অনুযায়ী ইসরায়েল যেতে কোনো বাধা থাকল না বাংলাদেশিদের।
তার মতে, ‘সেটা সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, যেতে পারবেন কি না। কিন্তু পাসপোর্টটা অ্যালাউ করে যেতে। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টে কখনো এটা লেখা ছিল না।’
আরেক কূটনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌসও মনে করেন, এতে ইসরায়েলে প্রবেশে বাধা কাটল।
তিনি বলেন, ‘লেখা নেই যেহেতু ইসরায়েলে প্রবেশ করতে পারবেন, এখন এটা ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করে তারা যেতে দেবে কি দেবে না। দুটো দেশ একে অপরকে রিকগনাইজ না করলে সাধারণত যাওয়া-আসার সুবিধাটা দেয়া হয় না।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেনের কাছে জানা গেল, ইসরায়েল, তাইওয়ান ও সাউথ আফ্রিকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাসপোর্টের বৈধতা ছিল না।
তিনি বলেন, ‘বর্ণবৈষম্যের অবসান হলে সাউথ আফ্রিকাকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। তাইওয়ানকে কিন্তু আমরা স্বীকার করি না। স্বীকৃতি দিই না আলাদা দেশ হিসেবে; চীনের অংশ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল কারণে তাইওয়ানের নিষেধাজ্ঞা আমরা তুলে দিয়েছি।’
পাসপোর্টে যতক্ষণ ওই কথাটি লেখা ছিল, ততক্ষণ ইসরায়েলে যাওয়ার উপায় ছিল না বলে জানান তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখতে হবে। ইসরায়েল কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটাও দেখতে হবে। বাংলাদেশিদের তারা ঢুকতে দেয় কি না। যেহেতু বাংলাদেশ তাদের স্বীকার করে না, স্বীকৃতি দেয় না।’
বিদেশে নিযুক্ত কোনো ইসরায়েলি দূতাবাস থেকে যদি কোনো বাংলাদেশি নাগরিক আবেদন করে ভিসা নিয়ে দেশটিতে যায়, সেটা রাষ্ট্র অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করবে কি না, জানতে চাওয়া হয় কূটনীতিকদের কাছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি স্পেসিফিক নিষেধাজ্ঞা জারি রাখে, অর্থাৎ কোনো নাগরিক ইসরায়েলে যেতে পারবেন না, এ রকম যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে, তাহলে সেটা হতে পারে। এগুলো তো ইলেকট্রনিক পাসপোর্টের সব তথ্য। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, না যাচ্ছেন অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের কাছেও চলে আসবে। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও যদি আপনি যান, তাহলে সরকার ব্যবস্থা নিতেই পারে আপনার বিরুদ্ধে।’
নাসিম ফেরদৌস বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ না থাকলে এটাতে ধরার খুব একটা সুযোগ নেই। কারণ, আপনি বলতে পারবেন, ডিফেন্ড করতে পারবেন যে, এখানে তো লেখা নেই ইসরায়েল যেতে পারব না।’
বহাল আছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েলে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে এক্সসেপ্ট ইসরায়েল শব্দটি তুলে নেয়া হয়েছে পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান রক্ষার জন্য এবং এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের ব্যাপারে তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তার দীর্ঘদিনের অবস্থানে অটল আছে।
ফলে পাসপোর্টে ভ্রমণ জটিলতা দূর হলেও নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাংলাদেশি নাগরিকরা যেতে পারবেন না ইসরায়েলে।
তবে কি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে এক্সসেপ্ট ইসরায়েল শব্দ তুলে দেয়ার ঘটনায় ঢাকার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে তেল আবিব।
এক টুইটবার্তায় রোববার ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপমহাপরিচালক গিলাড কোহেন এ সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তিনি লিখেন, ‘অনেক বড় খবর। বাংলাদেশ ইসরায়েলের সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে। এবার বাংলাদেশ ও ইসরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলে উভয় দেশের জনগণ লাভবান হবে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমরা বাংলাদেশকে স্বাগত জানাচ্ছি।’
কিন্তু এটা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রক্রিয়া নয় বলে জোর গলায় বলছে সরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ইট ডাজনট মিন, এর ফলে বাংলাদেশ এবং ইসরায়েলের সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এখনও তাদের রিকগনাইজ করি না। এখনও আমাদের আগের যে অবস্থান, সে অবস্থানে আছি।’
রোববার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইসরায়েল নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে এবং যত দিন পর্যন্ত সেখানে দুই রাষ্ট্র নীতি (ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র) বাস্তবায়ন না হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘কোনো দেশের পাসপোর্টে সম্ভবত এই রেস্ট্রিকশনটা আর নেই। এ কারণেই হয়তো আমাদের সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মানে এই না যে, আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছি।’
পাসপোর্টের মর্যাদা কি বাড়বে
এই পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের পাসপোর্টের মর্যাদা বাড়বে বলে মনে করেন না কূটনীতিকরা।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার মনে হয় না ইসরায়েলের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে কি না, তার সঙ্গে র্যাঙ্কিংয়ের কোনো সম্পর্ক আছে।’
তিনি বলেন, ‘র্যাঙ্কিংটা হয়, যে দেশগুলো এমন ফিল করে বাংলাদেশি কেউ এসে তার এখানে ইলিগ্যাল থেকে যাবে না, তারা অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়। যে পাসপোর্ট দিয়ে বেশিসংখ্যক দেশে অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়, তার র্যাঙ্কিং তত বেশি।’
গ্লোবাল পাসপোর্ট ইনডেক্সের র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পাসপোর্টের অবস্থান ৭৩।