করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতে চলছে লকডাউন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধ যাতায়াতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি এবং পথে পথে তল্লাশিচৌকির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে অপরাধীরা। ফলে সীমান্ত দিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে মাদক ও অস্ত্রের কারবার।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক পাচার প্রতিরোধে যুক্ত বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিবি, এলিট ফোর্স র্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
নিউজবাংলাকে তারা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার দুষ্কৃতকারী ও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই অবৈধ মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র কারবারিদের কাছে চাহিদামতো আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক সরবরাহের তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে।
তবে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার প্রায় সব পথ বন্ধ থাকায় এবং লকডাউনের কারণে অস্ত্র ও মাদক কারবারিরা বিপাকে পড়েছে। অবৈধ অস্ত্র বা মাদকের চালান নিয়ে সীমান্ত এলাকায়ই আসতে পারছে না তারা।
এ প্রসঙ্গে বিজিবির মুখপাত্র পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়েজুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, করোনায় বেশির ভাগ সীমান্ত পথ বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশি নাগরিকরা সীমান্তের ছয়টা পথ দিয়ে দেশে প্রবেশ করছেন। প্রবেশের পর তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধ পথসহ পুরা সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে; ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ করা হয়েছে।
অবৈধ অস্ত্র কারবারিদের নিয়মিত নজরদারিতে যুক্ত ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তেলকূপি, যশোরের বেনাপোল, সিলেটের গোয়াইনঘাট, পার্বত্য অঞ্চলসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা দিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র হরহামেশাই দেশে নিয়ে আসত কারবারিরা। সম্প্রতি ভারতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দেয়া হয়। ভাইরাসটির ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে বাংলাদশের পক্ষ থেকেও সীমান্ত এলাকায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এতে কিছু বাংলাদেশি নাগরিক দেশে প্রবেশ করলেও তারা কঠোর তল্লাশির মধ্যে পড়ছেন।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ভারতে জোরালভাবে লকডাউন কার্যকর থাকায় সে দেশের কারবারিরা অস্ত্র নিয়ে বসে থাকলেও মুভমেন্ট করতে পারছে না। ভারতের বিহারে অনেক নকল আগ্নেয়াস্ত্রের কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে নানা হাত ঘুরে মিজোরাম হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে অনেক ভারী অস্ত্র মাঝেমধ্যেই পাচার করেছে কারবারিরা। সম্প্রতি একাধিক অস্ত্র উদ্ধার ও কারবারিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় সিটিটিসি।
তারা জানান, বর্তমানে ওই রুটের কারবারিদের সঙ্গে দেশীয় কারবারিদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেলেও তারা অস্ত্র নিয়ে মুভ করার সাহস পাচ্ছে না। সবাই লকডাউন প্রত্যাহারের অপেক্ষায় রয়েছেন।
সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের ইল্লিগ্যাল আর্মস এনফোর্সমেন্টের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) কড়া পাহারায় রয়েছে, যার কারণে সীমান্ত দিয়ে বৈধ-অবৈধ সব ধরনের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। এ জন্য সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক, বিশেষ করে ফেন্সিডিল সরবরাহ একেবারেই কমে গেছে। আগে বৈধ যাতায়াতকারীদের কাছ থেকেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, যা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না।
‘কড়াকড়ির কারণে অবৈধ কারবারিরা পাচারের ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করছে। তবে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফও সতর্ক অবস্থায় থাকায় সেখানকার কারবারিরা সীমান্ত এলাকায় আসার সুযোগ পাচ্ছে না।’
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনাকালে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে মাদক ও অস্ত্র কারবারিদের কিছুটা নিষ্ক্রিয় মনে হলেও তারা নানা কৌশলে পণ্য পাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পাচারের চেষ্টা করছে তারা। নৌপথে বিভিন্ন ছদ্মবেশেও এ অপতৎপরতা চালাচ্ছে তারা। আমরাও তাদের কৌশল সম্পর্কে জেনে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে যাচ্ছি। ফলে তারা ধরা পড়ছে। উদ্ধার হচ্ছে মাদক ও অস্ত্র।’
ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই লকডাউন থাকায় অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ কমে গেছে। তবে দেশীয় কারবারিরা প্রায় প্রতিদিনই অস্ত্র সরবরাহের চাহিদার কথা জানিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে পার্শ্ববর্তী দেশের কারবারিদের সঙ্গে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই অবৈধ অস্ত্রের চালান পাঠানো হবে বলে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। অস্ত্রের পাশাপাশি ফেনসিডিলের সরবরাহও প্রায় বন্ধ রয়েছে।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, সীমান্তের সব এলাকা নজরদারিতে আনা সম্ভব নয়। তাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তেলকূপি, যশোরের বেনাপোল ও সিলেটের গোয়াইনঘাট। যেসব পয়েন্ট দিয়ে মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের চালান নিয়ে আসে কারবারিরা।
তিনি জানান, পার্বত্য এলাকা দিয়ে আসে একে টুটু, একে ফোরটি সেভেনের মতো ভারী অস্ত্র। ছোট অস্ত্রগুলো ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও ভাড়াটে খুনিরা ব্যবহার করে থাকে। ভারী অস্ত্র, বিশেষ করে একে টুটু ও একে ফোরটি সেভেনের মতো আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র বা জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতার তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা শাখার কাছে।
বিজিবির সিলেট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আহমেদ ইউসুফ জামিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেঘালয়ে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। সেখানকার কাউকেই আমরা ঢুকতে দিচ্ছি না। বিজিবির স্পেশাল টহল টিমের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। কাজেই এখান দিয়ে কেউই যাতায়াত করতে পারছে না।’