সাত বছর বয়সী মাশরাফির চোখের সামনে বাবা সাহিনুদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
ওই ঘটনার পর থেকেই মাশরাফি মানসিক সমস্যায় ভুগছে বলে জানিয়েছেন ওর মা মাহমুদা আক্তার। তার ১১ বছর বয়সী মেয়ের মধ্যেও নানা পরিবর্তন চোখে পড়ছে বলে জানান তিনি।
মনরোগ চিকিৎসকরা বলছেন, এখুনই চিকিৎসা না নিলে ভবিষ্যতে এটা বড় সমস্যায় রূপ নিতে পারে।
বাচ্চা দুটির মা মাহমুদা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, আমার ছেলে মাশরাফির খুব সমস্যা হচ্ছে। ও বলে, ‘আমার মাথা ধরে থাকে। মাথা ঘুরায়।’ ওই দিন কী হইছিল জানতে চাইলে বলে, ‘আম্মু, আমি কিছু বলতে পারি না’।
‘আমার ছেলে আগে স্পষ্ট কথা বলতে পারত। ও এখন কথা বলতে পারছে না ঠিক মতো। আমি যতদূর বুঝতে পারছি, আমার ছেলের মাথায় বড় একটা সমস্যা হইছে। মাশরাফি কখন কী বলে ওর হুঁশ নাই। এখান থেকে একটু বলে, ওখান থেকে একটু বলে। বলে আম্মু আমার মাথায় ভালো লাগে না।’
মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘মাশরাফি মাথার চুলগুলা ধরে যেন কিরকম করে। শুধু বলে, ‘আমার মাথায় খারাপ লাগতাছে।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। গত পরশু দিন বলতে শুরু করেছে, ‘আমার আব্বু আসলে খাব, গোসল করবো। না আসলে গোসলও করবো না, খাবও না।’
‘প্রথম তিন দিন একেবারেই তারা দুই ভাই-বোন খাওয়াদাওয়া করে নাই। তাদের স্বাভাবিক জীবনে আনতে পাড়া-প্রতিবেশি তাদের আদর দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেছে।’
মেয়ে সুমাইয়া শাহিনের সমস্যার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ে হাফেজি পড়ে। মেয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছে। ওর ভেতরে থম ধরে গেছে। ও কথা কইতেছে না। আমার কান্না দেখে ও বলে আম্মু তুমি কেঁদো না। ওর ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে।
বড়দের এই সব ভয়ানক অভিজ্ঞতায় মানসিক সমস্যা কম হলেও ছোটদের বেলায় ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাচ্চা দুইটির মানসিক সমস্যার বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হকের সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, এই বাচ্চারা একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। একে তো বয়স কম, তার ওপর চোখের সামনে প্রিয় আপনজনের নির্মম মৃত্যু। অবশ্যই এই কারণে এই বাচ্চাদের ভেতরে ট্রমা (তীব্র মর্মাঘাত) তৈরি হয়েছে। এই ট্রমা সাধারণ মন খারাপের মতো নয়।
‘ট্রমার চিকিৎসা যদি না করা হয়, তাহলে এই ট্রমা নিয়েই বাচ্চা দুইটা বড় হবে। এই বিষয়গুলো ঘুরে ফিরে বার বার ওদের মধ্যে ফিরে আসবে। ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় সমস্যা হবে।’
ট্রমার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে ড. মেহজাবীন হক বলেন, যখন একজন মানুষ ট্রমার ভেতর দিয়ে যায়, আর এই ট্রমার ভেতরে থেকে যদি তাকে বের করে না আনা হয় তাহলে হতাশা, আত্মহত্যা, খারাপ সঙ্গে চলে যাওয়া ও মাদক গ্রহণসহ অনেক কিছু হতে পারে। মোট কথা ওর পড়ালেখা, স্বাভাবিকভাবে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, মানুষকে বিশ্বাস করা এই যায়গাগুলোয় সমস্যা হবে। ওর প্রতিদিন এমন মনে হতে পারে, ঘটনাটি এখুনই ঘটেছে। চোখের সামনে ভাসবে, ঘুম হবে না, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলবে।
লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল
তাদের দ্রুত চিকিৎসা নেয়ার কথা জানিয়ে ড. মেহজাবীন হক বলেন, ‘এই দুই বাচ্চা ও তাদের মায়ের থেরাপি নেয়া খুব জরুরি। কারণ স্বাভাবিক শোক আর এই শোক এক না। এই শোকে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়। আমাদের এখন অনেক ধরনের ট্রমা থেরাপি রয়েছেন। ইএমডিআর থেরাপিটা আমাদের দেশে এখন আছে। ইএমডিআর হোল ট্রমা ম্যানেজমেন্টের জন্য একটি ইন্টিগ্রেটিভ সাইকোলজিকাল থেরাপি।’
গত ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দীন নৃশংসভাব খুন হন। তাকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
পরদিন সাহিনুদ্দীনের মা মোসাম্মদ আকলিমা রাজধানীর পল্লবী থানায় ২০ জনের নামে মামলা করেন। এতে সাবেক এমপি এম এ আউয়ালকে প্রধান আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় ১৪-১৫ জনকে।