সচিবালয়ে সরকারি তথ্য চুরির অভিযোগে অবরুদ্ধ হওয়ার পর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের দোষ স্বীকারের যে ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তা আদালতে উপস্থাপনের আদেশ দিয়েছেন বিচারক। এটি দেখার পর আদালত জামিন বিষয়ে আদেশ দেবেন বলে জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জামিন শুনানি শেষে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের (সিএমএম) হাকিম বাকী বিল্লাহ জানিয়েছিলেন, এই দিনই (বৃহস্পতিবার) জামিন বিষয়ে আদেশ দিয়ে দেবেন। কিন্তু দুই ঘণ্টা পর জামিন বিষয়ে আদেশ না দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে আসামির স্বীকারোক্তির ভিডিও ফুটেজ জমা দেয়ার আদেশ দেন।
ওই ফুটেজ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রোববার জামিন বিষয়ে আদেশ দেয়া হতে পারে বলে জানান বিচারক।
শুনানি শেষে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. হেমায়েত উদ্দিন খান (হিরন) সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছি এবং আসামিপক্ষও বক্তব্য উপস্থাপন করেছিল। মামলাটি আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল।
‘কিছুক্ষণ আগে বিজ্ঞ বিচারক বাকী বিল্লাহ একটি আদেশ দিয়েছেন। সে আদেশে উল্লেখ করেছেন যে, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামির স্বীকারোক্তির যে ভিডিও ফুটেজ আছে সেটা আদালতে উপস্থাপন করব। সেই ভিডিও ফুটেজ উপস্থাপন করার আলোকেই আগামী রোববারের জন্য এই মামলার পূর্ণাঙ্গ আদেশের দিন ধার্য করেছেন। এটাই হলো এ মামলার সর্বশেষ আদেশ।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী রোববার অর্থাৎ ২৩ মে রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট উপস্থাপন এবং সেটা পর্যালোচনা করে আদেশ দেবেন বলে আমরা জেনেছি। কথা হলো এই যে ডকুমেন্ট উপস্থাপন, কী ডকুমেন্ট রাষ্ট্রপক্ষ দেবে সেটা সম্পর্কে যদি ডিফেন্স অবগত না হয় এবং কথা বলার সুযোগ না পায় তাহলে আমি মনে করি ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে।’
গত মঙ্গলবার মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে লড়েন আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। তবে ব্যক্তিগত কারণে বৃহস্পতিবার শুনানিতে ছিলেন না। তার হয়ে শুনানি করেন সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ।
শুনানিতে জামিনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় (৩ ও ৫ ধারা) অভিযোগ আনা হয়েছে, তা জামিন অযোগ্য।
এর বিরোধিতা করে রোজিনা ইসলামের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী আদালতকে বলেন, জামিন পাওয়া রোজিনা ইসলামের আইনত অধিকার। তিনি জামিন পাওয়ার অগ্রাধিকার রাখেন। যেহেতু আসামি নারী এবং অসুস্থ, সুতরাং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৭, উপধারা ১-এর বিধান অনুযায়ী তিনি একজন প্রিভিলেজড পারসন। যেহেতু এ অভিযোগ জামিনযোগ্য এবং জামিন পাওয়ার জন্য তিনি আদালতের বিবেচনা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সুতরাং তার জামিন মঞ্জুর করা হোক।
সোমবার রোজিনাকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি কক্ষে আটকের কিছু ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রোজিনাকে সোফায় বসিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা জেরা করছেন।
তখন রোজিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তো ভুল করছি, আমি বললাম। মুচলেকা দিয়ে দেই।’
বৃহস্পতিবার শুনানি চলাকালে এহসানুল হক সমাজী জামিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার পাশাপাশি এজাহারের দুর্বলতাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। সেই অভিযোগের এজাহারে পেনাল কোডের ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ৩ ও ৫ ধারার কোনো উপাদান নেই।
তিনি বলেন, ‘৩৭৯ ও ৪১১ ধারা সংযুক্ত করতে হলে অবশ্যই কী কী চুরি হয়েছে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকতে হবে। কিন্তু সেই বর্ণনা এজাহারের কোথাও নেই। অর্থাৎ রোজিনা কী ডকুমেন্ট চুরি করেছিলেন সেটার উল্লেখ নেই। সেই সাথে জব্দ তালিকা দেয়া আছে, সেটা পুলিশ রোজিনার কাছ থেকে উদ্ধার করেনি, বরং একজন সরকারি কর্মকর্তা সেগুলো পুলিশের কাছে উপস্থাপন করেছেন।
‘তাই কথিত চুরি করা ডকুমেন্ট রোজিনার কাছ থেকে উদ্ধার করেছেন কি না কিংবা তিনি আসলেই চুরি করেছেন কি না সে নিয়ে আইনি প্রশ্ন থেকে যায়। তা ছাড়া অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারা হলো গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত। রোজিনা গুপ্তচারিতা করছিলেন এজাহারে কোথাও এমনটি উল্লেখ নেই। আর ৫ ধারা হলো রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শত্রুর কাছে হস্তান্তর করতে যোগাযোগ করা। এমন কোনো তথ্যও এজাহারে নাই।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী সমাজী বলেন, ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের সেকশন ১২ মতে আইনের ৩ ধারা ছাড়া অন্য সব ধারায় অপরাধ জামিনযোগ্য। এই রেফারেন্সে আমরা রোজিনার জামিন চেয়েছি। আমি বিজ্ঞ আদালতকে বলেছি, এই ঘটনায় রোজিনার জামিন পাওয়া তার প্রতি কোনো দয়া নয় বরং তার আইনি অধিকার। সি ডিজার্ভস টু বি রিলিজড অন বেইল।’
সচিবালয়ে সোমবার এক কর্মকর্তার কক্ষে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় অবরুদ্ধ রাখার পর রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। মামলায় রোজিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নথি চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে।
পরদিন তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। মামলায় রোজিনাকে পাঁচ দিনের জন্য রিমান্ডে পেতে আবেদন করেছিল পুলিশ। শুনানি শেষে এই আবেদন নাকচ করে দেন বিচারক মোহাম্মদ জসীম।
জামিন আবেদন করেছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। এই আবেদন আংশিক শুনানি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখেন বিচারক। রোজিনাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কাশিমপুর কারাগারে।
শুরু থেকেই রোজিনাকে মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। সাংবাদিক নেতারা এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মন্ত্রীরা আশা প্রকাশ করে বলেছেন ন্যায্য বিচার পাবেন রোজিনা।