সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ট্রিমকার বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) মাধ্যমে অনেকেই এই অ্যাপে যুক্ত হয়ে লাইভ চ্যাট করছেন ও খেলছেন অনলাইন জুয়া। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিদিনই কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁদে পড়ে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি সর্বস্বান্ত হয়েছেন। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহেও।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) বুধবার জানিয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের এই কারবারে যুক্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানা গেছে।
এটিইউ এবং সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্ট্রিমকার অ্যাপ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও ভিপিএনের মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশ-বিদেশের লক্ষাধিক বাংলাদেশি এই অ্যাপ ব্যবহার করছেন। সেলিব্রেটি ও তরুণীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা। তাদের অনেকেই এই অ্যাপের মাধ্যমে তরুণীদের ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে চাকরির টাকা খুইয়ে চলেছেন। ফলে বিপুল অঙ্কের রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।
স্ট্রিমকারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার চারজন
এটিইউ-এর সাইবার ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সুপার মাহিদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, নিষিদ্ধ স্ট্রিমকার অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিনই কোটি টাকার বেশি পাচার হচ্ছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে যারা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, এমন একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সাভার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয় বিধায় বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করবে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ থেকে এই অ্যাপের মাধ্যমে যারা অর্থ পাচার করছেন তাদের অন্যতম মাসুদ আর খান এজেন্সির মালিক মাসুদ রানাসহ অন্তত ছয়জন, যারা সবাই পলাতক রয়েছেন। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, স্ট্রিমকার অ্যাপের ইউজার হওয়ার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বা অর্থ স্থানান্তরের অনলাইন প্লাটফর্ম পেপালের মাধ্যম টাকা নিয়ে থাকেন এজেন্টরা। সেখানে ইউজাররা প্রবেশ করে অসংখ্য হোস্ট আইডিধারী তরুণী ও সেলিব্রেটির সঙ্গে লাইভে কথা বলার সুযোগ পান। এসব হোস্টের মধ্যে কেউ গান শোনান। কেউ কবিতা শোনান। এজন্য তাদের উপহার হিসেবে দিতে হয় বিন্স নামের ভার্চুয়াল মুদ্রা, যে মুদ্রা মোবাইল ব্যাংকিং বা পেপালের মাধ্যমে কিনতে হয়। এই অ্যাপে ছয় ধরনের জুয়া খেলার সুযোগ রয়েছে। হোস্টরা নানা কৌশলে ইউজারদের সেই জুয়ার বোর্ডে নিয়ে যান।
বাংলাদেশি ইউজারদের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক, যারা সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকেন। প্রবাসী এই শ্রমিকদের কাছে অবসরে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে লাইভে কথা বলার জনপ্রিয় মাধ্যম এই অ্যাপ। দেশীয় ইউজাররা ভিপিএনের মাধ্যমে এই অ্যাপ ব্যবহার করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া স্ট্রিমকারের বিজ্ঞাপন
অ্যাপটির বৈশিষ্টের বর্ণনা দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, এ এটি বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও ও অডিও স্ট্রিমিং সোশ্যাল অ্যাপ। বৈশ্বিক বন্ধুত্বের প্লাটফরম হিসেবে এই অ্যাপ দিয়ে ভিডিও প্রচার ও ভিডিও চ্যাট করা যায়। বিশ্বজুড়ে বন্ধুত্ব করা যায়।
এই অ্যাপের ইউজার বাড়ানোর জন্য অনলাইনে অসংখ্য বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে প্রতারক চক্র। যেমন- ‘অনলাইন থেকে ঘরে বসেই টাকা কামান। ইনকাম করুন প্রতিদিন এক হাজার টাকা। সময় নষ্ট আর নয়, সাথে সাথেই পেমেন্ট। আগ্রহ থাকলে অবশ্যই আমার ইনবক্সে join লিখে পাঠান।‘
কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে বলা হয়, we are hiring broadcaster. Who can do: Talkative Live, Lipsing woth music, Reciting poem, singing, Gossiping.
আবার কোনো কোনো বিজ্ঞাপনে থাকে, ঘরে বসে টাকা ইনকামের সুযোগ শুধুমাত্র লাইভ করে। মাসে মাত্র ১৫ দিনে ৪০ ঘণ্টা লাইভ করে আয় করুন হাজার হাজার টাকা।
আগ্রহীদের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়, মাসে ১৫ দিনে ৪০ ঘণ্টা লাইভ করতেই হবে। কথোপকথনের অভ্যাস থাকতে হবে। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তির অভ্যাস থাকতে হবে। লাইভগুলো হবে অনেকটা ফেসবুক লাইভের মতো। বেতন নির্ধারিত হবে আইডিতে ‘জেমস’ কয়েন জমা হওয়ার ওপর।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘স্ট্রিমকার’ অ্যাপটিতে দুই ধরনের ভার্চুয়াল কারেন্সি থাকে। এদের একটিকে ‘বিন্স’ আরেকটিকে ‘জেমস’ বলা হয়। ইউজাররা হোস্টের (সুন্দরী তরুণী) সঙ্গে কথোপকথনের সময় ‘উপহার হিসেবে’ ভার্চুয়াল কারেন্সি ‘বিন্স’ দিয়ে থাকেন। এই উপহার আসলে বাধ্যতামূলক। ইউজারের বিন্স তরুণীর আইডিতে জমা হওয়ার পর সেটি জেমস হিসেবে বিবেচিত হয়। এক বিন্স সমান এক জেমস। এ ক্ষেত্রে এক লাখ জেমসের দাম ৬০০ টাকা ধরা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া স্ট্রিমকারের বিজ্ঞাপন
এই অ্যাপে এজেন্সি দুই ধরনের। বিন্স এজেন্সি ও হোস্ট এজেন্সি।
বিন্স এজেন্সি
বিন্স এজেন্সিগুলো অ্যাপের অ্যাডমিনের কাছ থেকে বিন্সগুলো কিনে থাকে। পরে সেগুলো তারা ইউজারদের কাছে সরবরাহ করে। দেশে বর্তমানে ১০-১২টি বিন্স এজেন্সি রয়েছে, যাদের মধ্যে তিন-চারটির বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট।
কর্মকর্তারা জানান, মুদ্রা পাচারে জড়িত এই এজেন্সিগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।
হোস্ট এজেন্সি
একটি হোস্ট এজেন্সির অবশ্যই ১৫টি সক্রিয় হোস্ট আইডি থাকতে হয়। না থাকলে হোস্ট এজেন্সি হিসেবে অনুমোদন দেয় না স্ট্রিমকার অ্যাপের অ্যাডমিন।
এটিইউয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ২০০ থেকে ৩০০ হোস্ট এজেন্সি রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের ১০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত সক্রিয় হোস্ট রয়েছে। সেই হিসাবে দেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ হোস্টিং করছে। ইউজার আছে লক্ষাধিক।
দুই ধরনের আইডি: একটি ইউজার আইডি, আরেকটি হোস্ট আইডি।
ইউজার আইডি
যেকোনো ব্যক্তি ইউজার আইডি খুলতে পারেন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার কিংবা গুগল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। বিন্স কিনে এবং তা উপহার হিসেবে সরবরাহ করে একজন পুরুষ কিংবা নারী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন; সময় কাটাতে পারেন হোস্টের সঙ্গে।
হোস্ট আইডি
প্রত্যেক হোস্টকে প্রত্যেক দিন অন্তত এক ঘণ্টা এবং প্রত্যেক মাসে অন্তত ৪০ ঘণ্টা লাইভ স্ট্রিমিংয়ে থাকতে হয়। এই সময়ের স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে একজন হোস্টকে ন্যূনতম ‘পেমেন্ট’ পাওয়ার জন্য ২০ লাখ জেমস উপহার হিসেবে পেতে হয়।
পেমেন্ট সাইকেল
যুক্তরাষ্ট্রের বংশোদ্ভূত জিমি নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এই অ্যাপের অ্যাডমিন হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকরা রয়েছেন। এই অ্যাডমিনদের কাছ থেকে দেশীয় এজেন্সিগুলো কম দামে বিন্স কিনে থাকে। তারপর তা বেশি দামে ইউজারদের কাছে বিক্রি করে। ইউজাররা হোস্ট আইডিধারী ব্যক্তিদের সঙ্গে নানা ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে বিন্সগুলো দেন। জুয়া খেলায়ও লাগে এই ভার্চুয়াল মুদ্রা।
বিন্সগুলো হোস্ট আইডিতে জেমস হিসেবে জমা হয়। সেই জেমস আবার হোস্ট এজেন্সির মাধ্যমে অ্যাপ অ্যাডমিনদের কাছে চলে যায়।
কর্মকর্তারা জানান, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় শত কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে প্রবাসীরাও এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে কোটি কোটি টাকা খোয়াচ্ছেন। অ্যাপের মূল ইউজার প্রবাসীরা হওয়ায় রেমিট্যান্সের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই অ্যাপের ক্ষতিকর দিক থেকে প্রবাসীদের ফিরিয়ে আনতে পারলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।
ইউজারকে এই বিন্স কিনতে হয় এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে। এজেন্সিগুলো এক লাখ ‘বিন্স’-এর দাম নিয়ে থাকে ১০৮০ টাকা। যদিও এজেন্সি ওই এক লাখ বিন্স ১০৩২ টাকায় কেনে অ্যাপ অ্যাডমিনদের কাছ থেকে।
ভার্চুয়াল কারেন্সি কাগুজে মুদ্রায় কীভাবে স্থানান্তর হয়- এমন প্রশ্নে এটিইউয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, একটি বিদেশি ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কনভার্ট করার তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, হোস্ট তরুণীর সঙ্গে লাইভে গল্প করতে করতে প্রলোভনে পড়ে ইউজাররা বিপুল পরিমাণ বিন্স সরবরাহ করে থাকেন উপহার হিসেবে। কখনো কখনো স্ট্রিমকার অ্যাপ থেকে বেরিয়ে ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হওয়ার হাতছানি থাকে। এজন্যও বিন্স জমা দিতে হয় হোস্টের আইডিতে। যেগুলো জেমস হিসেবে গণ্য হয়ে তরুণীর মাসিক আয়ের পথ তৈরি করা হয়।
কর্মকর্তারা জানান, এই হোস্টরাও অ্যাপের অ্যাডমিন কিংবা এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে থাকেন। যেসব শর্তের হোস্টিংকে যে পরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা বলা হয়, তা দেয়া হয় না। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে পুরো টাকাই হাতিয়ে নিচ্ছে অ্যাপভিত্তিক এই প্রতারক চক্র।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া স্ট্রিমকারের বিজ্ঞাপন
অ্যাপে চলে যেসব জুয়া: প্রতারক চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও এটিইউয়ের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তারা জানান, এই অ্যাপে ছয় ধরনের জুয়া খেলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- তিনপাত্তি, ক্রিকেট স্টারস, ট্রেজারহান্ট, এসকে ডার্বি, ফ্রুট লুপস, লাকি ডিপ ও বিনস ব্যাগ।
কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, শুধু তিনপাত্তির মাধ্যমেই বাংলাদেশ থেকে প্রতি তিন মিনিটে এক লাখ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। একই কারণে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে পরিমাণ টাকা বাংলাদেশে আসার কথা তা আসছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এটিইউর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, অনেক প্রবাসী যুবক বিন্স কিনে ও জুয়ার ফাঁদে পড়ে তার মাসিক আয়ের পুরোটাই খুইয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, এই চক্রের সন্ধান পাওয়ায় ও তাদের গ্রেপ্তারের ফলে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। দেশ থেকে মুদ্রা পাচারও বন্ধ হবে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিআইজি কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, স্ট্রিমকার অ্যাপ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগের আরও কিছু মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। নিয়মিত ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরের কোনো মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশদ তদন্ত চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া ও তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করা হবে।