বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বীরাঙ্গনা কমলার ক্যামোথেরাপি হবে না?

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ১৫ মে, ২০২১ ১৯:৫৮

২০১৭ সালের ১৩ জুন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা। প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। এই টাকা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছিল। তবে ক্যান্সার তছনছ করে দিয়েছে জীবন। চিকিৎসক বলেছে ছয়টা ক্যামোথেরাপি দিতে হবে। তবে একটি দিয়ে টাকার অভাবে বাকিগুলো আর দিতে পারেননি।

‘পাঁচ বছরের বেশি সময় ধইরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হইছি। থাকতাছি একটা পরিত্যক্ত ঘরে। প্রশাসনের কাছে আবাস ও চিকিৎসার অর্থ সহায়তার আবেদন করছি।

‘সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন কইরা ভুল করছি। তাদের অফিসে দৌড়াদৌড়ি কইরা পায়ের জুতা ক্ষয় করছি। আশ্বাস ছাড়া সহায়তা দিছে না কেউ।’

এই বলে চোখের পানি মুছতে থাকেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের ঘরে মেয়ে ছিল তাদের পরিবার ছিল সবচেয়ে দুশ্চিন্তায়। তড়িঘড়ি করে মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়া হতো। রাজাকারের সহায়তায় বা কোনোভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পড়লে ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা হতো। করা হতো গুলিও।

কমলাকে ক্যাম্পে রেখে সাতদিন অসহনীয় নির্যাতন করা হয়। তবে এক পর্যায়ে কৌশলে পালিয়ে আসেন ক্যাম্প থেকে।

২০১৭ সালের ১৩ জুন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা। প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। এই টাকা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছিল। তবে ক্যান্সার তছনছ করে দিয়েছে জীবন।

চিকিৎসক বলেছে ছয়টা ক্যামোথেরাপি দিতে হবে। তবে একটি দিয়ে টাকার অভাবে বাকিগুলো আর দিতে পারেননি।

কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার নওবাইত গ্রামের মেয়ে কমলা। বর্তমানে থাকছেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চরকালীবাড়ি মিলগেট এলাকায় রেলওয়ের পরিত্যক্ত জমিতে।

আবু হানিফ ও আবুল কায়সার মানিক নামে তার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। এখানে তারা পরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ছেলের একটি অটোরিকশা ছিল, মায়ের চিকিৎসা করতে সেটিও বিক্রি করে দিয়েছেন।

কমলার বাড়িতে ঈদ আসে না। গিয়ে দেখা যায়, একা বসে ঘরের ভেতর। ডাকলে বের হন তড়িঘড়ি করে।

কেমন আছেন?

কমলা খুলে বসেন তার দুখের ডালি।

বলেন, ‘১০ বছর যাবত সরকারি জমিতে থাকতাছি। উঠানের সামনে বড় পাগাড় (পুকুর)। এইহানে মানুষ থাহার জায়গা না। ভালা একটা জাগাতে সরকারি ঘর কইরা দিলে মরার আগে শান্তিতে ঘুমাইবার পারতাম। মনে অয় এই ইচ্ছা আমার পূরণ অইত না।’

বলেন, 'আমার যেহেতু ক্যান্সার ধরছে। আমি মইরা যায়াম। তয় মনে দুঃখ থাইক্যা গেল অর্থের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাইবার পারলাম না।’

জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ছিলেন তরুণী।

তার গ্রামের বাড়ির কাছে বালিয়া স্কুলে ক্যাম্প করেছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। স্বজনরা তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেন। তড়িঘড়ি করে নানসিঁড়ি গ্রামের কৃষক মাসুদুল আলমের কাছে বিয়ে দিয়ে দেন। মেয়েকে সুখে রাখতে তখন ১০ কাঠা জমিও দেন বাবা।

তবে স্বপ্ন আর ইচ্ছে নিমিষেই ছিন্নভিন্ন করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী।

বিয়ের মাত্র দুইদিন পর স্বামী আর শ্বশুর তাকে ফেলেই ভারতে চলে যান। শাশুড়ি তাকে পাঠিয়ে দেন বাবার বাড়ি। পথে এলাকার রাজাকার আসলামের সঙ্গে দেখা।

আসলাম শাশুড়িকে বলেন, কমলাকে তার বাবার বাড়িতে তিনিই পৌঁছে দিতে চান। তবে তিনি তাকে নিয়ে যান পাকিস্তানি ক্যাম্পে।

সাত দিন পর কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে খালে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে পড়েন কমলা। রাতে পাশের একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। এক ভোরে এলাকার মানুষ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইতলী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে শুরু করলে তাদের সঙ্গে তিনিও যোগ দেন।

অন্তত ১৬ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা দলে কমলা ছাড়াও আরও তিন নারী সহযোগিতা করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ এলাকায় যাওয়া হয়নি তিনি। থেকেছেন ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায়।

স্বাধীনতার সাত বছর পর ময়মনসিংহ নগরীর নতুনবাজার এলাকায় তৎকালীন মোনায়েম খান এতিমখানার করনিক আবুল কাশেমের সঙ্গে আবারও সংসার পাতেন কমলা।

১৯৯৪ সালে স্বামী মারা যাওয়ার ৮ দিনের মাথায় শাশুড়ি ও ভাসুর মিলে কমলার ৭১ সালের কথা তুলে ধরে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে নগরীর ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক নারীর আশ্রয়ে থেকে চা দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানেই সন্তানদের বড় করেন। তবে টাকার অভাবে পড়াশোনা করাতে পারেননি।

২০১০ সালের পর কমলা আসেন ময়মনসিংহ নগরীর মিলগেইট এলাকায়। দুই ছেলেকে নিয়ে এখানেই রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়গায় বসবাস করছেন।

রাষ্ট্র সম্মান দিলেও কমলাদের দুঃখ যায়নি। বলেন, 'অনেকে বীরাঙ্গনাদের ভালা চোখে দেহে না। তারা ভাবে আমরা কলঙ্কিনী। কতো মানুষরে চাল-ডাল দিছে নেতারা। কই, আমি তো কিছুই পাইলাম না।’

তিনি বলেন, 'আমি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করবার পারাতাছি না। কেউ একটা অর্থের সাহায্য দিতাছে না। অনেক কষ্ট কইরা ঘরের সামনের দিকে দেয়াল করবার পারছি। এই পরিত্যক্ত জাগার ঝোপঝাড়ের ভেতরে থাকতে আমার কষ্ট অইতাছে। এই কষ্ট হুনবার মতো কোনো লোক নাই।

‘বীরাঙ্গনাদের দাম নাই দেইখ্যা আইজক্যা আমার এই অবস্থা। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাই।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন এই প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে বহু বীরাঙ্গনা দুর্বিষহ জীবন পার করছেন। তাদেরকে তালিকা করে সব ধরনের সরকারি সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।

‘তাদেরকে ভালো চোখে দেখতে হবে, সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে। বীরাঙ্গনা কমলার চিকিৎসা সহায়তাসহ তার নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বীরাঙ্গনা কমলার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। খোঁজখবর নিয়ে তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর