শুক্রবার বেলা ৪টা। বাড্ডা থেকে হাতিরঝিলে ঢোকার মুখে লোকেলোকারণ্য।
একপাশে একটি ফুচকার দোকান। আসন ফাঁকা নেই। তার পাশেই মেয়েদের মনোহারী ও শিশুদের খেলনার দোকান। তবে সেখানেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই।
করোনার বিধিনিষেধ না মানার প্রবণতা আর বদ্ধ জীবন থেকে স্বস্তি পেতে শুক্রবারা নগরবাসীর ঢল নামে হাতিরঝিলে। নগরবাসীর অলিখিত বিনোদন কেন্দ্র পরিণত হয়েছে হাতিরঝিল।
শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে হাতিরঝিলে। ছোট ছোট রেস্তোরাঁতে বসার জায়গা নেই। বয়স্কদের থেকে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। সঙ্গে রয়েছে শিশুরাও। কেউ ছবি তুলছেন, একা বা দল বেঁধে। কেউ এসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে।
করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধে এবার শেকড়ের টানে ঢাকা ছাড়তে পারেনি অনেক মানুষ। তাই ঈদের ছুটিতে হাতিরঝিলে মানুষের উপস্থিতি বেশি।
সামাজিক দূরত্ব মানার বা করোনাভীতি কারও মধ্যে কাজ করেনি। ছবি: ছবি: সাইফুল ইসলাম
কী বলেছেন তারা?
দর্শনার্থীরা বলছেন, ঈদে পরিবহনের বিধিনিষেধের কারণে অনেক মানুষ গ্রামে যেতে পারেননি। আর তাই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বের হয়ে একটু মুক্ত ও খোলামেলা জায়গার খোঁজে হাতিরঝিলে এসেছেন সাধারণ মানুষ।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মাহাবুবুর রহমান। হাতিরঝিলে এসেছেন স্ত্রী ও ছোট বাচ্চাকে নিয়ে।
মাহাবুবুর বলেন, পরিবার ছেড়ে ঢাকায় ঈদ করতে হচ্ছে, এখানে আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। আমার পরিবার নিয়ে শুধু আমি আছি। স্ত্রী দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি। ঈদের ছুটিতে সে বাইরে বের হতে চাইছিল। তবে ঢাকায় তো কোনো বিনোদন কেন্দ্র খোলা নেই। তাই বিনোদনের খোঁজে এখানে এসেছি।
রীতিমতো মেলা জমে উঠেছিল হাতিরঝিলে। ছবি: ছবি: সাইফুল ইসলাম
টানা ছয় মাস বাড়িতে না যাওয়ার আক্ষেপ থেকে মাহাবুবুর বলেন, এটা একটা ফাঁকা জায়গা। চিন্তা করলাম একটু ঘুরে আসি। তবে এখানেও অনেকেই আমার মতোই স্বস্তি খুঁজতে এসেছেন।
করোনা নিয়ে মাহাবুবুর বলেন, সবার মনেই মৃত্যুর ভয় আছে, তবে কারও বিবেক জাগ্রত না। সবাই জানে যে এখানে এলে করোনা সংক্রমিত হতে পারে।
মধুবাগে থাকেন আয়েশা আক্তার। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। অনেক দিন এভাবে সময় কাটাইনি।’
করোনা নিয়ে কোনো আতঙ্ক কাজ করছে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সেফ আছি। করোনার ভয় করে না।’
সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ছবি: ছবি: সাইফুল ইসলাম
সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আরিফুল ইসলাম। ছোট্ট ভাতিজাকে নিয়ে এসেছেন হাতিরঝিলে। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বহু মানুষ এবার ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি। তাই একাকিত্ব কাটাতে আমার মতো অনেকেই এখানে এসেছেন।
করোনা সংক্রমণ নিয়ে ভয় পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে প্রথম দিকে সবার মতো আমারও ভয় ছিল। এখন সেই ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। অনেক দিন পর ভালো লাগছে।
একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন বলেন, ঘুরতে যাওয়ার তো আর জায়গা নেই। টানা এক বছর ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। সব সময় তো বাসায় থাকা হয়। ঈদের দিন কি বাসায় এভাবে থাকতে ভালো লাগে? তাই কয়েকজন বন্ধু নিয়ে একটু ঘুরতে এসেছি।
হাতিরঝিলের সব জায়গাতেই কম-বেশি মানুষের উপস্থিতি রয়েছে।
ওয়াটার বাস মানুষকে বাড়তি আনন্দ জুগিয়েছে। ছবি: ছবি: সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম নামের হাতিরঝিলের একটি রেস্তোরাঁর ওয়েটার জানান, আজকে ভিড় অনেক বেশি, কাস্টমার অনেক।
স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি। তবে সাধারণ মানুষ অনেকেই মানছেন না। এটা সব জায়গায় বলেই দাবি করেন তিনি।
হাতিরঝিলের লেকপাড়ের গোল চত্বরে যেন মেলা বসেছে। বেলুন, ফুচকা, ছোট-বড় মনোহারী দোকানে মানুষের ভিড় হাতিরঝিলকে অলিখিত বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলোতে চলছে জোর বিক্রি। ইন্ডিয়ান জনপ্রিয় খাবার দোসা, চিকেন, কাবাব কম দামে প্যাকেজ আকারে বিক্রি হচ্ছে এখানে।
আনন্দ নৌ ভ্রমণ প্যাকেজ
হাতিরঝিলের ভেতর লেকের মধ্যে বিনোদনপ্রেমীদের জন্য চালু করা হয়েছে আনন্দ নৌ ভ্রমণ প্যাকেজ। মেরুল বাড্ডামুখী লেকের টিকিট কাউন্টারে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। সেখানে কাগজে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখা রয়েছে ৮০ টাকায় নৌ ভ্রমণ প্যাকেজ। লেকের ভেতর নৌকাতে ২০ মিনিট ঘোরা যাবে এই প্যাকেজের আওতায়।
তবে টিকিটের লাইনে ভিড়ে সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো লক্ষণ নেই। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে মাজাহারুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ঈদের দিন ঘুরবো না তো কবে ঘুরবো ভাই। করোনা এখন আর নেই। ঢাকায় তো আর কোনো বিনোদন কেন্দ্র নাই। সবাই আমার মতোই ভেবে এখানে এসেছে।
স্বাভাবিক সময়ে সাধারণত বিকেল পার হলেই মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে। তবে আজ ভিন্ন অবস্থা। গত ঈদে প্রাণ হারানো হাতিরঝিল যেন এবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।