চীন ও রাশিয়া উদ্ভাবিদ টিকা নিজেরাই উৎপাদনের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ করছে তাতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পরিস্থিতিতে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, বিশেষ করে মাস্ক পরতে জনগণের প্রতি অনুরোধ করেছেন তিনি।
ঈদুল ফিতরের আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে করোনা পরিস্থিতিই বেশি গুরুত্ব পায়। এ সময় তিনি টিকাদানের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই ভাষণ দেন সরকার প্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়েই আমরা গণটিকা কার্যক্রম শুরু করেছি। আপনারা জেনেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিকা রপ্তানির উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’
বাংলাদেশ গণটিকা শুরু করে এক কোটি তিন লাখ টিকা হাতে নিয়ে। এ ছাড়া সিরাম থেকে মাসে ৫০ লাখ করে টিকা আসার কথা ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির পর দেশে আর কোনো টিকা আসেনি। এই পরিস্থিতিতে টিকা কার্যক্রম নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
করোনাপ্রতিরোধী এই টিকা একজনকে দিতে হয় দুটি করে। প্রথম ডোজের টিকা বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। যে ৫৮ লাখকে এই ডোজ দেয়া হয়েছে, তাদের ১৩ লাখের বেশি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার মতো মজুত নেই।
এই পরিস্থিতিতে চীন ও রাশিয়া উদ্ভাবিত টিকা নিতে চুক্তি করেছে সরকার। এই দুটি টিকা দেশেই উৎপাদনের বিষয়েও আলোচনা চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশেই যাতে টিকা উৎপাদন করতে পারি সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। নিজেদের টিকা তৈরিতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আমরা দেশের সকল নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসব, ইনশাআল্লাহ।’
চীনের সিনোভ্যাকের ৫ লাখ উপহারের টিকা দেশে পৌঁছার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। জানান, টিকা পাওয়ার জন্য আমেরিকার কাছেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সারা বিশ্বে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাক্সের কাছ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকা পাওয়া যাওয়ার কথাও জানান শেখ হাসিনা।
বলেন, ‘বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। খুব শিগগিরই দেশে টিকা আসতে শুরু করবে।’
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনামাস্ক পরুন
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে মাস্ক ব্যবহারের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। জানান, এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসু বলে প্রমাণিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘনঘন সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করুন।
‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই সঙ্গে সঙ্গে আপনারা নিজেরা গরম পানির ভাপ নিতে পারেন।’
লকডাউন ছাড়া বিকল্প ছিল না
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার পর গত ৫ এপ্রিল থেকে চলাচলে বিধিনিষেধ তথা লকডাউন দেয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, এই ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ এড়াতে লক-ডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ করতে হয়েছে।’
২০২০ সালেও টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এর ফলে অগুণতি মানুষের রুটি-রুজির উপর আঘাত এসেছে। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।
‘কারণ, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি দেশেরই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর একটি নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে রোগী বাড়তে থাকলে তখন সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।’
জনসমাগম এড়াতে না পারলে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ কারণে কষ্ট হবে জেনেও আমরা বাধ্য হয়েছি মানুষের স্বাভাবিক চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে। দোকান-পাট, শপিং মলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখতে হচ্ছে। একই কারণে গণপরিবহন চলাচলের উপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।’
ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ যেসব পেশার কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামনে থেকে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘সংবাদকর্মীগণ সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সংবাদ পরিবেশনের কাজ করে যাচ্ছেন। সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন হাসপাতাল স্থাপন, চিকিৎসক ও নার্সসহ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, দেশের ১৩০টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর কথাও তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
জীবন ও জীবিকার সামঞ্জস্যের চেষ্টা
সরকার জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাদের সহায়তার জন্য সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
গত বছর করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত এক লাখ ২৯ হাজার ৬১৩ তের কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, এর মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১টি খাতে সর্বমোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর অনুদান বাবদ ৮ হাজার ২৬০ কোটিরও বেশি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
গত বছর সাময়িক কর্মহীন ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৯১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এ বছরও সমসংখ্যক মানুষকে সম পরিমাণ টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬০৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, সাধারণ শ্রমিক, নিম্নআয়ের মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবকগণ, বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক - ইত্যাদি পেশার মানুষজন এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন।
মহামারির সময়েও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের ভাতা, খাদ্য কর্মসূচি, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ সব ধরনের সরকারি সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথাও তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
জানান, এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ। এরমধ্যে বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ, খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ২ কোটি ১৮ লাখ এবং বৃত্তি-উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৩ লাখ।