ঈদ যেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির উপলক্ষ না হয় সে জন্য জনগণের সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আনন্দঘন পরিবেশে আরও ঈদ করা যাবে।
ঈদুল ফিতরের আগের সন্ধ্যায় জাতির জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রায় ১৬ মিনিটের এ ভাষণের একটি বড় অংশ জুড়েই করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন সরকার প্রধান।
বলেন, ‘এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে এবারও আমাদের ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে হচ্ছে। আমরা ঈদ উদযাপন করব, তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
‘কোনোভাবেই এই ঈদ উদযাপন যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির উপলক্ষ হয়ে না উঠে, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
গত বছরের মতো এবারও ঈদ উদযাপনে কালছায়া নেমে এসেছে করোনার কারণে।
শহর ছেড়ে মানুষের গ্রামমুখী যাত্রা ঠেকাতে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে সরকার। তবে ছোট গাড়িতে দল বেঁধে মানুষের বাড়িমুখো যাত্রা বন্ধ থাকেনি। বিশেষ করে ফেরিঘাটে হাজার হাজার মানুষের জড়ো হয়ে নদী পার হওয়ার প্রবণতায় করোনা সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্টত উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘জনগণের প্রতি অনুরোধ: আপনারা আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে যাবেন না।
‘অনেকের কোনো বাহ্যিক লক্ষণ না থাকায় আপনি বুঝতে পারবেন না আপনার পাশের ব্যক্তিটিই করোনাভাইরাস বহন করছে। এর ফলে আপনি যেমন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়বেন, তেমনি আপনার নিকটাত্মীয় বা পাড়া প্রতিবেশীকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন।’
সবার উপরে মানুষের জীবন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকলে আসছে বছর আবার আমরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে পারব।’
‘আসুন, আমরা সবাই যে যেখানে আছি সেখান থেকেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করি’- যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার ওপরও জোর দেন শেখ হাসিনা। বলেন, এর মধ্যেই ঈদের আনন্দ।
‘আজকের দিনে আমরা হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, লোভ, অহমিকা, ক্রোধ, অহঙ্কার ইত্যাদি যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শপথ নেব’-বলেন তিনি।
মসজিদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ পড়ুন
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের মতো এবারও ঈদগাহে জামাত আদায়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘মসজিদে মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।’
গরিবের পাশে দাঁড়ান
দুঃসময়ে দরিদ্র প্রতিবেশী, গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়াতে বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘আপনার সাহায্য হয়ত একটি পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাবে। দেখবেন, তাঁদের হাসিমুখ আপনার হৃদয়মনকেও পরিপূর্ণ করে তুলবে ঈদের আনন্দে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সবচেয়ে বড় কর্তব্য। আমরা যেন এই কর্তব্যকর্ম ভুলে না যাই।’
‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে; আসেনি কেউ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’-কবি কামিনী রায়ের কবিতার এই লাইনগুলোও স্মরণ করিয়ে দেন শেখ হাসিনা।
স্বাস্থ্যবিধিতে জোর
করোনা প্রতিরোধে ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসু বলে প্রমাণিত হয়েছে।
‘কাজেই বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘনঘন সাবানপানি দিয়ে হাত ধুইয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই সাথে সাথে আপনারা নিজেরা গরম পানির ভাপ নিতে পারেন।’
বক্তব্যের শুরুতেই সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়া, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভেঙে পড়া, জীবন-জীবিকায় অনিশ্চয়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয়টি তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
গত বছরের শেষ দিকে পরিস্থিতির উন্নতির পর আবার অবনতির বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ছিল বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘গত বছরের শেষদিকে যখন বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ অনেকটা কমতে শুরু করেছিল, তখন সকলের সঙ্গে আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম যে বিশ্ববাসী বুঝি এই মরণঘাতী ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি থেকে দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের সকল পরিকল্পনা ও প্রত্যাশাকে নৎস্যাৎ করে দেয়।’
করোনা মোকাবিলায় টিকাদান কর্মসূচিতে ছেদ পড়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকা রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রাশিয়া ও চীনের উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। এই দুটি উৎস ছাড়াও বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে গড়ে উঠা আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাক্স থেকেও টিকা পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা কেনার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশেও উৎপাদন হবে।
করোনা মোকাবিলায় নতুন হাসপাতাল স্থাপন, চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি, সাড়ে চার হাজার নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগসহ নানা উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণে প্রাণহানি কমাতেই লকডাউন দেয়া হয়েছে বলে ব্যাখা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, বাধ্য হয়েই মানুষের চলাচলে বিধি নিষেধ দেয়া হয়েছে।
জীবন ও জীবিকার মধ্যে সরকার একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের সহায়তার জন্য সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’
প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিতে ভাটার শঙ্কা
করোনার প্রথম বছরে মহামারিজনিত আর্থিক অভিঘাত ভালোভাবেই সামাল দেয়া গেলেও এবারের পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহার প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন প্রথম ঢেউ সামলিয়ে অর্থনীতিকে সাবেক অবস্থার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসার পর্যায়ে, তখনই মার্চ মাসে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। এতে করে আমাদের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিতে হয়ত খানিকটা ভাটা পড়বে।’
তার পরেও এবারও আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী শেখ হাসিনা।
বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
‘চলতি বোরো মওসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। বেশির ভাগ ধান ইতোমধ্যেই চাষি ভাইদের ঘরে উঠেছে। সুষ্ঠুভাবে ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে হারভেস্টার বিতরণ অব্যাহত রেখেছি।’
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকদের ধান কাটতে সহায়তা করার বিষয়টিও জানান তিনি। বলেন, ‘পবিত্র রমজান মাসে আমাদের দলের কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইফতার ও সেহরি বিতরণ করেছে।’