রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের পেছনে এনজিও ব্যুরো অফিস সংলগ্ন দেয়াল ঘেঁষে ছোট্ট একটি বস্তি। সেখানে ৯ বছরের প্রতিবন্ধী শিশু রুবেলকে নিয়ে বাস করছেন মর্জিনা বেগম নামে এক নারী। এই পথ ধরে হাঁটতে গেলেই চোখে পড়ে তাকে।
বুধবার দুপুরে কথা হলো মর্জিনার সঙ্গে। শুনালেন তার জীবন সংগ্রামের কথা। তার সুনির্দিষ্ট কোনো আয় নেই। যে যা দেয়, তা দিয়ে জীবন চালান।
জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী তার ছেলে।
কাজ করেন না কেন-এমন প্রশ্নে মর্জিনা বলেন, ‘ছেলেডারে দেখব কে? হেয় তো কথা কইতে পারে না। কানেও শুনে না। আমি কামে গেলে হেরে দেখব কে?’
তার সন্তানকে অন্যরা অবজ্ঞা করতে পারে, কিন্তু মায়ের কাছে সে ‘ময়না পাখি।’
মর্জিনা বলেন, ‘এইডা আমার ময়না পাখি। আমার বাবা। ওরে নিয়ে রাস্তায় বসে কামাই কইরা খাই।’
রংপুরের পীরগাছা থানার উত্তর আমচন্দ্রপাড়া গ্রামে জন্ম এই নারীর। বিয়ে হয়েছিল এক কৃষকের সঙ্গে। টেকেনি সংসার। স্বামী ছেড়ে চলে যান। আর বিয়ে করেননি মর্জিনা।
এই খুপড়িতেই ছেলেকে নিয়ে থাকেন মর্জিনা। ছবি: নিউজবাংলা
দুই ছেলে এক মেয়েসহ মোট তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এই নারী। বড় ছেলে শফিকুল রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। থাকেন রংপুর।
মেয়ে বুলবুলিকে বিয়ে দিয়েছেন ময়মনসিংহে। তিনি ঢাকার আদাবরে স্বামীর সঙ্গে থাকেন।
আপনি কীভাবে চলছেন?
-মর্জিনা বলেন, এখনকার অফিসের অনেক ‘স্যার’ আছেন। তারা তাকে সাহায্য করেন। এনজিও ব্যুরো অফিসের এক নারী কর্মীও প্রায়ই তার খোঁজ খবর নেন।
‘অনেক স্যার আমারে আদর করেন’- বললেন অনেকটা গর্ব ভরে।
ছেলের চিকিৎসা করেন?
-‘না, ডাক্তার কইছে এই রোগের ওষুধ নেই। ব্যায়াম করতে হইব। এইডা আমি পারি না।’
মর্জিনার গ্রামে কোনো জায়গা-জমি নেই। বন্যায় সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। ৫৫ বছর ধরে এই বস্তিতে আছেন মর্জিনা।
করোনায় সরকার গরিব–দুস্থদেরকে যে নগদ টাকা দিয়েছে, চাল দিয়েছে, তার কিছু পাননি বলেও জানালেন।
বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের জন্য মাসিক ভাতাও পাননি তিনি। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্যও সরকারি সুযোগ সুবিধার কিছু জোটে না তার।
ঈদে কী করবেন- এমন প্রশ্নে বলেন, ‘আর কী করুম? কেউ খাওন দিলে খামু, না দিলে না খামু। আমার নিজের তো আর কিইন্যা খাওনের ট্যাকা নাই। সবার খুশির সঙ্গে আমিও খুশির ঈদ করমু।’
‘ঈদ তো সবার জন্য’-মন্তব্য তার।
তবে এরই মধ্যে মর্জিনা উপহার পেয়েছেন। এক ‘খালা’ তাকে নতুন কাপড় কিনে দিয়েছেন। কিছু টাকাও দিয়েছেন।
মর্জিনার মুখে মাস্ক নেই।
কেন?- এমন প্রশ্নে তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘পরি, তয় কম। দম আটকায়া যায়।’
করোনার টিকাও নেননি তিনি। বলেন, ‘আমি টিকা নিব না। মরণ আসলে চইলা যাব, তবু টিকা দিব না।’
আপনার মনে বিশেষ কোনো কষ্ট আছে?
প্রশ্ন শুনে মর্জিনা বললেন, ‘অনেক কষ্ট বাবা। আমার বাড়ি নেই, ঘর নেই। রাস্তায় থাকি, রাস্তায় খাই। কতজনে কত কথা বলে। এই কষ্ট আর সয় না বাজান।’
তবে স্বপ্ন এখনও দেখেন তিনি। কারও দয়া দাক্ষিণ্যে বাঁচতে চান না। যেখানে জন্মেছেন সেই গ্রামে ফিরে যেতে চান। কেউ একটি মুদি দোকান করে দিলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
মর্জিনার ভাষায়, ‘মানুষের দয়ায় আর চলতে চাই না। এই কষ্ট আর ভালা লাগে না। আমি বুড়া হয়া গেছি। নিজের ঘরত শান্তিতে থাকতে চাই।’