সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে গাছ কাটার প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সচিবালয়ের পাশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘গাছ কাটার পর দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হলে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। সেই কমিটি অপ্রয়োজনীয়ভাবে পরিকল্পনার বাইরে কোনো গাছ কাটা পড়েছে বা পড়বে কি না যাচাই করবে। সেখানে কোনো ব্যত্যয় পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাথে স্বাধীনতার স্মৃতি জড়িত উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, এখানেই শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হিসেবে উপাধি দেয়া হয়। এখানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনে জয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু এখানেই এমপিদের শপথ বাক্য পাঠ করান।
তিনি বলেন, ‘১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা নিয়ে এখানেই ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে তিন মাসের মধ্যে মিত্র বাহিনী ফেরত যাবে। এখানেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। তাই এটা আমাদের আবেগের জায়গা।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে অভিযোগ করে মন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানি আমলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠ। এখানে মদ ও জুয়ার আসর বসত। বঙ্গবন্ধু এটা বন্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ইতিহাস মুছে ফেলতেই জিয়াউর রহমান সেখানে শিশুপার্ক নির্মাণ করেন।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনায় শিশুপার্ক রেখেছি অন্য আদলে। যে ইতিহাস তারা ভুলাতে চেয়েছিল, সেটাকে মানুষ যেন মনে রাখে সেজন্য আমরা এই শিশুপার্কটিকে বুমেরাং হিসেবে রাখব।’
তিনি বলেন, ‘এটি আওয়ামী লীগের সম্পদ নয়, এটি জাতীয় সম্পদ। এখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিশ্বের সামনে আমাদের গর্বের ইতিহাস তুলে ধরতেই আমরা এই মহাপরিকল্পনা নিয়েছি।’
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ইতিহাস রক্ষা করতেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এখানে শিখা চিরন্তন নির্মাণ করে। আবার সেই ইতিহাসকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতেই স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশের সকল ইতিহাস মানুষকে জানাতে এই উদ্যানকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে।’
উদ্যান নিয়ে মহাপরিকল্পনা
সংবাদ সম্মেলনে আ ক ম মোজাম্মেল হক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে মহাপরিকল্পনার বিস্তারিত জানান।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা আগে সকলের উদ্দেশে জানাতে পারিনি, সেটি আমাদের ব্যর্থতা। এজন্যই সাধারণের মাঝে ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেরি করে হলেও আমরা আজকে আপনাদের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা সাধারণ মানুষকে জানাচ্ছি।’
মন্ত্রী বলেন, ‘তবে আমাদের বিশ্বাস, পরিকল্পনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে এখন যারা সমালোচনা করছেন তারা ঠিকই খুশি হবেন।’
তিনি বলেন, ‘উদ্যানে ৭ মার্চের ভাষণের স্থানে ২৬ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে। পাকহানাদার বাহিনীর ভাস্কর্য থাকবে ২৩ ফুট উচ্চতার। নির্মাণ করা হবে ইন্দিরা মঞ্চ, ৫০০ গাড়ির জন্য বেইজমেন্ট পার্কিং, ওয়াটার ফাউন্টেইন, টয়লেট সুবিধাসহ ৭টি ফুড কিয়স্ক, মসজিদ ও ওয়াকওয়ে।’
উদ্যানের ভেতর কোনো খাবার দোকান বা রেস্টুরেন্ট হচ্ছে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় হাজার হাজার খাবারের দোকান আছে, সেসব ফেলে উদ্যানের ভেতরে খাবার খেতে যাবে কে? উদ্যানের ভেতরে রেস্টুরেন্ট নয়। থাকবে ছোট ফুড কিয়স্ক, যেখানে হালকা শুকনা খাবার পাওয়া যাবে। ফুড কিয়স্কেতে বসে খাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হালকা নাশতা খাবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে পরিকল্পনা সেটি বাস্তবায়িত হলে এখানে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার লোকের সমাগম হবে। বিদেশি পর্যটকসহ প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী আসবেন। পাশাপাশি আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে ২ হাজার শিক্ষার্থীকে এই উদ্যানে নিয়ে আসব, তারা যেন সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। তাদের তো এই হালকা খাবার আর টয়লেটের ফ্যাসিলিটি দিতেই হবে।’
গাছ কাটার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি না জনতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘গাছ কাটা নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই, যা আছে সেটি হলো নিয়ম মেনে গাছ কাটা হচ্ছে কি না। গাছ কাটার বিষয়ে সরকারি নীতিমালা আছে আমরা সেটিই অনুসরণ করছি।’
উদ্যানের ভেতরে আগেও গাছ না কেটেই ওয়াকওয়ে করা হয়েছিল, এবার সেটি কেন সম্ভব হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘নকশা অনুযায়ী ১০০টি গাছ কাটার পরিকল্পনা ছিল, এর মধ্যে পঞ্চাশটি গাছ কাটা হয়েছে। আরও ৫০টি গাছ কাটার জন্য নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে। কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। তারা যাচাইবাছাই করে গাছ আরও কম কাটা যায় কি না সে সিদ্ধান্ত নেবে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরাই আমাদের পরিকল্পনার সমালোচনা করছেন। আমরা ঈদের পর তাদের সাথেও বসব। তাদের পরামর্শ শুনে আরও কিছু সংযোজন করা যায় কি না সেটিও বিবেচনা করব। এখানে কারো ইগোর বিষয় না, জাতীয় স্বার্থে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেব।’
প্রকল্প বাস্তবায়নে শুধু গাছ নিধনই হচ্ছে না, বরং ১০ গুণ গাছ লাগানো হবে বলেও জানান মন্ত্রী। এজন্য বোটানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘কেটে ফেলা গাছগুলোর বিপরীতে আরও ১ হাজার গাছ লাগানো হবে। বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ আগামী এক মাসের মধ্যে এই গাছ লাগানোর কার্যক্রম শুরু হবে।’