আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে রাজধানীর ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটায় আদালত অবমাননায় হাইকোর্টে মামলা করেছেন এক আইনজীবী।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রোববার মামলার এ আবেদন করেন।
মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্বা মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী শামিম আখতার এবং চিফ অর্কিটেক্ট অফ বাংলাদেশ মীর মনজুর রহমানের বিরুদ্ধে আজ সকালে মামলার আবেদন করা হয়েছে।
‘আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় আদালত অবমাননার অভিযোগে আবেদন করেছি। আবেদনে গাছ কাটা বন্ধের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না; নির্মাণ কাজ কেন বন্ধ করা হবে না এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে।
এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত ভাস্কর্য, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য, ইন্দিরা মঞ্চ, জলাশয় ও ফোয়ারা, ভূগর্ভস্থ ৫০০ গাড়ির পার্কিং ও শিশুপার্ক।
এ ছাড়া দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য পুরো উদ্যানজুড়ে সাতটি ফুড কোর্ট ও টয়লেট নির্মাণ করা হবে। আর মনোরম পরিবেশের জন্য বানানো হবে নান্দনিক ওয়াকওয়ে।
এ জন্য উদ্যানের বেশ কিছু পুরাতন গাছ এরই মধ্যে কাটা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৫ দিন ধরে অর্ধশতাধিক পুরোন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কাটা পড়েছে উদ্যানের পুরনো গগণ শিরিষ, সেগুনের মতো গাছও। এছাড়া, কেটে ফেলার জন্য চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে আরও শতাধিক গাছ।
উদ্যানের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলা গাছের গুড়ি দেখা গেছে। টিএসসি প্রান্তের গেট দিয়ে উদ্যানে ঢুকতেই চোখে পড়ে বেশ কিছু গাছের গায়ে লাল রং দিয়ে ক্রস চিহ্ন। এগুলোও কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গাছ কাটা শুরু হলে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন বুধবার দুপুরে উদ্যানে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানবন্ধনও করেছে।
বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করতে গাছগুলোকে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীকদের নামে নামে নামকরণও করেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় উদ্যানকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আরও গাছ লাগানোর কথা জানিয়েছে।
এর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধ করতে ও আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গত ৬ মে আইনি নোটিশ পাঠান এ আইনজীবী।
নোটিশে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালে করা রিটের প্রেক্ষিতে তৎকালীন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ উদ্যান সংরক্ষণে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সেই রায়ে বলা হয়, রমনা তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা নিছক একটি এলাকা নয়। এই এলাকাটি ঢাকা শহর পত্তনের সময় হতে এ পর্যন্ত একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এর একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐহিত্য আছে।
‘শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র এই এলাকা। এই পরিপ্রেক্ষিতেও সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসাবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। এখানে এমন কোনো স্থাপনা থাকা উচিত নয় যা এই এলাকার ইতিহাস-ঐহিত্যকে ম্লান করে। পরিবেশগত দিক থেকে তা আরও উচিত নয়। কারণ রমনার উদ্যান বা রমনা রেসকোর্স ময়দান ঢাকা শহরের দেহে ফুসফুসের মতো অবস্থান করছে। কোনোভাবেই একে রোগাক্রান্ত করা যায় না।’
রায়ে আরও বলা হয়, যেহেতু স্মরণকাল থেকেই এটি উদ্যান হিসেবে পরিচিত, সেহেতু ২০০০ সালের ৩৬ নং আইন অনুসারে সোহরাওয়ার্দী ‘উদ্যান’ সংজ্ঞার আওতাধীন এবং এই জায়গার শ্রেণি সাধারণভাবে অপরিবর্তনীয়। একে অনাবশ্যক স্থাপন দিয়ে ভারাক্রান্ত করা অবৈধ হবে।’
আইনজীবী নোটিশে বলেন, আদালতের রায় উপেক্ষা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থে রেস্টুরেন্ট-দোকান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ ধংস করে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যা রায়ের পরিপন্থি।
যে নির্দেশনা ছিল আদালতের
রেসকোর্স ময়দান বা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহকে চিহ্নিত করা এবং সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বাদী হয়ে জনস্বার্থে ওই রিট করেছিলেন।
২০১০ সালের ৭ জুলাই রায় প্রকাশ করা হয়, রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক সাতটি স্থানকে চিহ্নিত করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত।
স্থানগুলো হলো: ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের স্থান, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ দল থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের স্থান, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের স্থান, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রদানের স্থান এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ প্রদানের স্থান।
হাইকোর্ট সেই রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে অংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেটিকে ‘স্বাধীনতা চত্বর বা লিবার্টি স্কয়ার’ নামকরণ করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিল।
সেই সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সব স্থাপনা অপসারণ এবং স্থাপনা অপসারণের পর চিহ্নিত স্থানগুলোতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিনন্দন ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ এবং সংরক্ষণের নির্দেশও দিয়েছিল হাইকোর্ট।
রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আলাদতের পরিষ্কার নির্দেশনা ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাতটি চিহ্নিত জায়গায় স্মৃতি ভাস্কর্য ছাড়া অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। এমনকি উদ্যানের জায়গা থেকে শিশুপার্ক ও শাহবাগ থানাকেও উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল। সে জায়গায় নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর রেস্টুরেন্ট টয়লেট বানাবে এটা তো আদালত অবমাননা।'