এ বছরেই জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। তবে করোনা মহামারি ও প্রবল বন্যায় কাজের ব্যাঘাত ঘটায় পঞ্চম দফায় আরও দুই বছর বেড়েছে এই প্রকল্পের মেয়াদ। এ বছরের শুরুতে ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় সেতু বিভাগ। এর ভিত্তিতে প্রস্তাবের যৌক্তিকতা যাচাই করতে ফেব্রুয়ারিতে সেতু পরিদর্শনে যায় পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
এর ভিত্তিতে মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করে আইএমইডি। কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ হয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাব যায় পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তরে। চলতি সপ্তাহে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পে মেয়াদ বাড়ানোর ওই প্রস্তাবে সই করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।সেতু বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৯৩ শতাংশ। আগামী বছরের জুনেই সেতুর মূল কাজ শেষ হওয়ার আশা রয়েছে।
সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। নদীশাসনের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ।
রোববার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্ট্রাকচারের পুরো কাজ শেষ হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে ভায়াডাক্টের সর্বশেষ গার্ডার স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্ট্রাকচারের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সেতু যান চলাচলে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাসহ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। তবে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই মূল সেতুর কাজ শেষ হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে পঞ্চম দফা সময় বেড়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে। তবে নির্মাণকাজ শুরুর পর মেয়াদ বেড়েছে তৃতীয় দফা। ২০০৭ সালের ২৪ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প প্রথম অনুমোদন পায়, মেয়াদ ছিল ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা করা হয়। তবে সময় বাড়ে ছয় মাস, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি একনেকে ব্যয় বাড়িয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
২০১৮ সালের ২১ জুন ভূমি অধিগ্রহণের জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলে ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পরে আরও দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে যথাক্রমে ডিসেম্বর ২০১৯ এবং জুন ২০২১ করা হয়। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানোয় ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। পরে কাটছাঁট করে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ হাজার ৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এতে গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ পর্যন্ত প্রকল্পে পুঞ্জীভূত ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ বলছে, করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হয়েছে। গত বছর প্রকল্পে কর্মরত বিদেশি পরামর্শক ও চীনা ঠিকাদারের অনেক লোক দীর্ঘদিন কাজে ফিরতে পারেননি। আবার গত বছর প্রবল ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। তীব্র স্রোতের কারণে মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ভাঙনের মুখে পড়ে। তবে কাজের অগ্রগতি বিবেচনায় মূল সেতু ও নদীশাসন কাজ ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ও ঠিকাদারের দেনাপাওনা মিটিয়ে দিতে সময় লাগবে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
দ্বিতল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক ও নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন, এজন্য আলাদা প্রকল্পও রয়েছে। গত মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-মাওয়া অংশে কাজের অগ্রগতি ঘুরে দেখেন রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন।
পদ্মা সেতুর ওপর রেল ও সড়কপথ একই দিনে চালু হবে জানিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী বছরের মাঝামাঝি যখন পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে, ঠিক একই দিনে সেতুর ওপর দিয়ে রেলপথও চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। অর্থাৎ একই দিনে পদ্মা সেতুর রেল ও সড়কপথ চালু হবে।
রেলপথমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তবে তখন শুধু ভাঙা থেকে সেতু পার হয়ে মাওয়া পর্যন্ত রেল আসবে। মাওয়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেল প্রকল্পের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই এই কাজও শেষ হবে। এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। রেলের মূল অংশটা পদ্মা সেতুর মূল সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে। এখন রেলের স্লিপার বা রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে।’