হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযানের মধ্যেই সংগঠনের একজন নেতা জানিয়েছেন, তারা ক্ষমতায় এলে কাদের কাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে, সেই তালিকা করে রাখা হয়েছে। এদের সবার চোখ টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
একটি ওয়াজে ওই নেতার বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, একদিন তাদের সংগঠনের আমির জুনায়ের বাবুনগরী দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন আর মামুনুল হক হবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন তারা ফতোয়া বোর্ড গঠন করে কেবল ফাঁসির রায় দেবেন।
ওই আলেমের নাম নূর হোসাইন নূরানী। তিনি হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। পাশাপাশি আহমদিয়াবিরোধী আন্দোলন করা খতমে নবুওয়ত আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সভাপতি।
ওই ওয়াজটি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকায় হয়েছিল, সেটি ব্যানারেই স্পষ্ট।
ওয়াজটি গত ২২ এপ্রিলের আগে হয়েছিল সেটি নিশ্চিত। কারণ, ওই দিন নিজ এলাকা মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নূরানীকে।
ব্যানারে প্রধান অতিথি হিসেবে নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেনের। সভাপতি হিসেবে নাম আছে কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ কবিরের। অতিথি হিসেবে নাম ছিল উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম আহমেদ আজাদের।
তবে মুরাদ কবির নিউজবাংলাকে জানান, তিনি সেখানে যাননি।
তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে মৌচাক এলাকায় এই মাহফিলটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে আমার নাম-পদবিসহ কালিয়াকৈর ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী মহোদয়, চেয়ারম্যান বা সেলিম আজাদ কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেই সরেজমিনে যাচ্ছি, খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
হেফাজতবিরোধীদের যেভাবে শাস্তির পরিকল্পনা
সেই ওয়াজে মুফতি নূরানী দাবি করেন, তাদের সংগঠনের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক মাতৃগর্ভ থেকে ‘অপরাধমুক্ত ফেরেশতার মতো আলেম’।
বাবুনগরীকে বাংলাদেশের ‘রুহানি রাষ্ট্রপতি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার অঙ্গুলি হেলনেই চলবে বাংলাদেশ।’
অন্য একটি মামলায় নূর হোসাইন নূরানীকে গত ২২ এপ্রিল গ্রেপ্তার করেছে মুন্সিগঞ্জ পুলিশ
মামুনুল হকের চেহারায় ‘প্রধানমন্ত্রীর ভাব’ আছে বলেও মনে করেন তিনি।
মুফতি নূরানী বলেন, ‘জুনায়েদ বাবুনগরী আমিরুল মুজাহিদিন (জিহাদ করা বাহিনীর প্রধান) হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। আর আমিরুল মুকমিনিন (রাষ্ট্রপ্রধান) হিসেবে তার কাজ শেষ হবে।’
তিনি বলেন, ‘ফিতা দিয়ে মেপে ইঞ্চি ইঞ্চি বিচার করব ইনশাল্লাহ। আমরা ন্যাশনাল ফতুয়া বোর্ড গঠন করে করে রায় দেব আর গাছে গাছে ফাঁসিতে ঝুলতে থাকবে ইনশাআল্লাহ। ন্যাশনাল ফতুয়া বোর্ড হবে, যা রায় দেব তাই কার্য়কর হবে দেশে।’
তিনি বলেন, ‘যে মাপের নেতা হন, ১০ হাত না ১২ হাত, তালিকা বানাই রেখেছি। যথাসময়ে বিচারের আওতায় তাদেরকে আনা হবে। একজনও রেহাই পাবে না।’
ফাঁসিতে ঝোলানোর পাশাপাশি আর কী শাস্তি দেয়া হবে, সেটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চোখ টান দিয়া খুলে ফেলা হবে। আর চোখ রাঙাইতে দেরি হবে, তার জান কবজ করতে দেরি হবে না।’
মুফতি নূরানী বলেন, ‘যিনি আঘাত করবেন, তিনি তালগাছ না বেলগাছ, এমপি না মন্ত্রী ছাতা-মাথা দেখব না। বাপ-দাদা ১৪ গোষ্ঠীর নাম ভুলায় দিব, ঠিক কি না জোরে কন।’
‘পরিষ্কার লড়াইয়ের ঘোষণা’ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অচিরেই ডাক আসবে খালি বস্তা হাতে নিয়ে ১৭ কোটি মুসলমান মাঠে নামবে। গারো পাহাড় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের যত নাস্তিক মুরতাদ ইঁদুরের মতো গর্তের ভিতর থেকে বের করে বস্তায় ঢুকাব। সারা বাংলা পরিষ্কার করে ওই পটুয়াখালীর কুয়াকাটার সাগরে নিয়া ভাসায় দিব।’
যুবলীগ নেতা ও ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনকেও হুমকি দেন মুফতি নূরানী। বলেন, ‘মধুপুর পীর সাহেব (মুন্সিগঞ্জের আবদুল হামিদ) যদি বলেন, নিক্সন চৌধুরীর ঢাকায় ঢুকা নিষিদ্ধ। তোর বাবাও এপার দিয়ে যেতে পারবি না।’
মুফতি নূর হোসাইন নূরানী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে জানতে হেফাজতের অবস্থান জানতে চাইলে মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন ধরলেও প্রশ্ন শুনেই জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
কিছুই জানে না পুলিশ
সেই ওয়াজ ও নূর হোসাইন নূরানীর বক্তব্যের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর কাছে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কালিয়াকৈর থানা এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তবে মৌচাক এলাকায় যদি কোনো ওয়াজ মাহফিল করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিপূর্বে থানা থেকে ওয়াজ মাহফিলের বিষয়ে অনুমতি দেয়া হয়নি।’
বারবার উগ্র বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় নূরানী
মুফতি নূরানী এর আগেও নানা সময় উগ্র বক্তব্য নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। রাজধানীর ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার কথা তিনিই বলেছিলেন।
ধোলাইপাড়ের সেই সমাবেশে সেদিন তিনি বলেন, ‘মূর্তি কীভাবে ভাঙতে হয় নবীপ্রেমিক মুসলমানরা জানেন। মূর্তির সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমানরা কোনো দিন আপস করবে না। ধোলাইপাড়ে মূর্তি বানানো হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হবে।’
গত ১৪ নভেম্বর ধোলাইপাড়ে ইসলামী আন্দোলনের জনসভায় মুফতি নূরানী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হলে বুড়িগঙ্গায় ফেলার হুমকি দেন
মুফতি নূরানী চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তার উগ্র কথাবার্তার কারণে দল থেকে তাকে ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে অব্যাহতি দেয়া হয় বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন দলটির একজন নেতা।
তবে গত ১৪ নভেম্বর ঢাকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নূরানী।
তাকে গ্রেপ্তারের পর ওই ঘটনায় করা মামলাতেই কারাগারে রাখা হয়েছে।