করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঈদ উদযাপনে রাজধানী ছাড়তে গিয়ে যেন কোনো প্রাণহানি না ঘটে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভিডিও কনফারেন্সে বৃহস্পতিবার সকালে বরিশাল, রংপুর, পাবনা ও সিলেটে নতুন চারটি মেরিন একাডেমিসহ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ছয়টি প্রকল্পের নতুন অবকাঠামো ও জলযান উদ্বোধন করার সময় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন করোনার সময়। আত্মীয়স্বজনের সাথে তো বেঁচে থাকলে দেখা হবেই। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঈদ উপলক্ষে সবাই ছোটাছুটি না করে, যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদটা উদযাপন করেন।
‘যারা বিত্তশালী আছেন, তারা পারলে দুস্থদের সহযোগিতা করেন। এটা আরও বেশি সওয়াবের কাজ হবে বলে আমি মনে করি। কাজেই নিজেরা সুরক্ষিত থাকেন।’
তিনি বলেন, ‘করোনা যাতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে, এ জন্য সবার কাছে আমার অনুরোধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলুন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত একেবারে না পারলে আপনারা করবেন না। এই যাতায়াতটা করতে গেলেই কে যে সংক্রমিত হবে, আপনি জানেন না। কিন্তু সে যখন অন্য জায়গায় যাবে অনেক লোককে এই করোনা সংক্রমিত করবে।
‘তাদের জীবন নিয়ে সংকট দেখা দেবে। সেটা যাতে না হয়, এ জন্যই আমরা এই যাতায়াতটা সীমিত করার পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু সেই সাথে যেন আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলো অব্যাহত থাকে সেটিও সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সে ব্যবস্থা আমরা করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে মানুষগুলোর জীবন চলে যায়, আপনজন হারিয়ে বেঁচে থাকেন তাদের কষ্টের কথাটা আপনারা একবার চিন্তা করবেন। কাজেই এটুকু ধৈর্য্য ধরতে হবে। যেকোনো একটা বিপদ আসলে ধৈর্য্য ধরতে হবে; সবুর করতে হবে। সেই সবুরটা সকলেরই করা উচিত। নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে।’
ঈদের এ সময়ে নৌযানে যাতায়াতকারী এবং পরিচালনাকারী সবাইকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ ছয় ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাস পরপর ঋতু পরিবর্তন হয়। এখন কালবৈশাখীর সময় যারা চলাচল করবেন একটু সাবধানে চলাচল করবেন।
‘যারা এই নৌযানগুলো চালান বা পরিচালনা করেন বা ব্যবসা করেন, যাত্রীদের সুরক্ষা যেমন তাদের দেখতে হবে, আবার যাত্রীদেরও নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করতে হবে। একটা নৌযানে কতজন মানুষ উঠতে পারে? ঠেলাঠেলি করে একসাথে সবাই উঠতে গিয়ে তারপর একটা এক্সিডেন্ট হবে আর নিজেদের জীবনটা চলে যাবে। এ ব্যাপারে সকলকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।’
এ সময় প্রত্যেক নৌযানেরই নিবন্ধন থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যেসব নৌযান চলাচল করে প্রত্যেকটিরই রেজিস্ট্রেশনের সিস্টেম থাকা উচিত। এই রেজিস্ট্রেশন না থাকার কারণে অনেক সময় ক্ষতিপূরণ ঠিক করা যায় না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার জানেন আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেরিন একাডেমি তৈরি করে দিয়েছি। উপযুক্ত ট্রেনিং দিচ্ছি।
‘আবার উন্নত ট্রেনিং দেশে এবং বিদেশের সমুদ্রপথেও যেন কাজ করতে পারে, এ জন্য বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিও করে দিয়েছি। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে এই জলযান পরিচালনা আমরা যদি করতে পারি, তাহলে এক্সিডেন্ট কিন্তু কমে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েকটি দিকে নজর দিতে আমি সবাইকে অনুরোধ জানাব। একটা হলো অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না করা। আর নৌকা বা নৌযান চলতে গেলে কিন্তু কতগুলো নিয়মও মেনে চলতে হয়।
‘হয়তো এক জায়গায় একটা ঘটনা ঘটল। সবাই একদিকে ছুটে গেলেন সেটা দেখতে। সেখানেই কিন্তু নৌকাডুবি হয়ে যেতে পারে বা লঞ্চ ডুবে যেতে পারে। কাজেই এ নিয়মগুলো মেনে চলা অপরিহার্য। সেদিকে সবাই মিলে দৃষ্টি দেবেন।’
ভিডিও কনফারেন্সে দেয়া বক্তব্যে করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এই মহামারি আমাদের দেশের মানুষকে সত্যিই খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
‘অতি দরিদ্র কর্মহীন বা দিনমজুর বা এখন কোনো কাজ করতে পারছেন না, রিকশাভ্যান পরিবহন শ্রমিক, কৃষক এবং স্বল্প আয়ের ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে ইতোমধ্যে আমরা আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করেছি। এ ছাড়া এই রোজার মধ্যে আমাদের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বিভিন্নভাবে আমরা এই সহযোগিতা করে যাচ্ছি।’
খনন হবে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ
২০২৪-২৫ সালের মধ্যে দেশের ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সর্বমোট ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। এর মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার পরিবহন কাজে ব্যবহার হতো। শুষ্ক মৌসুমে সেটি অর্ধেকে নেমে এসেছিল। সারা দেশে ব্যাপক নদী খনন করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, শুধু খনন করলেই চলবে না। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার পর প্রতি বছর কিন্ত মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করতে হবে।
‘একবার খনন করে ছেড়ে দিলেই চলবে না। এর কারণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি পলি বহন করি আমরা বাংলাদেশ। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।’
পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলো নৌপথের উন্নয়নে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পঁচাত্তরের পরে যারা ক্ষমতায় ছিল আপনারা যদি হিসাব করে দেখেন এ মাটিতে তাদের জন্ম ছিল না। এ দেশের মানুষকেও তারা জানে না। তারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী।
‘তারা এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। মানুষের উন্নয়নে তারা কোনো কাজ করেনি বা যে পদক্ষেপগুলো জাতির পিতা নিয়েছিলেন সে পদক্ষেপগুলি যতদিন পারে শুভফলটা ভোগ করেছে। কিন্তু তা অনুসরণ করে উন্নয়নে কোনো অবদানই রাখেনি।’
তিনি বলেন, ‘একসময় আমাদের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নৌপথ। সবচেয়ে অল্প খরচে আর নিরাপদে নৌপথেই পণ্য পরিবহন করা যায়। এর ফলে তার দামও কম হয় আর মানুষের কাজেও লাগে।
‘কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী যারা ক্ষমতায় আসে তারা ব্যবসাটা বড় করে দেখত। তাদের নানাজনের যেমন বাসের ব্যবসা, ট্রাকের ব্যবসা এসব ব্যবসার দিকে যতটা মনোযোগ দিয়েছে তারা নৌপথে সে যত্ন নেয়নি।’
‘ঘাসিয়ার খাল বন্ধ হলে কোথায় ছিলেন’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারীদেরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘একটা কথা আমি বলব। আমাদের অনেকেই সুন্দরবন নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেন, অনেক কথা বলেন। আমরা যখন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গেলাম তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
‘তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ঘাসিয়ার খালটা যখন বন্ধ হয়ে গেল আমাদের আন্দোলনকারীরা তখন চুপ ছিলেন কেন?’মোংলা বন্দরে নৌযানে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য ঘাসিয়ার খাল নামে একটি নৌপথ ব্যবহার করা হতো। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মোংলা বন্দর বন্ধ করে দিলে খালটিও ধীরে ধীরে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কখনো এ কথাটা আনেননি কেন যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহন করলে জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হবে আর পরিবেশও নষ্ট হতে পারে। যখন মোংলা বন্দরটা করা হয় তখনও যেন সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কিন্তু এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
‘আমরা যেটা করেছি সেটাও এখান থেকে অনেক দূরে এবং আমাদের ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ হিসেবে সুন্দরবনের যে অংশটা ঘোষণা দিয়েছে সেখান থেকেও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে।’
তিনি বলেন, ‘এখানেই আমরা সুপার ক্রিটিক্যাল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি। আর এই একটা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ওই অঞ্চলের মানুষ যাদের কোনো কাজই ছিল না। কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল না।
‘এই মোংলা বন্দরটাই তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দিত। এখন এই একটা প্রকল্প ঘিরে তাদের অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে এবং জায়গাটার অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে।’