করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় চলাচল রোধে পুলিশ চালু করে ‘মুভমেন্ট পাস’। এ নিয়ে শুরুরতে কড়াকড়ি দেখা গেলেও বিষয়টি এখন উধাও। অবশ্য পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, চলাফেরায় মুভমেন্ট পাস নেয়ার বাধ্যবাধকতা এখনও আছে।
বাস্তবে চলাফেরা করতে এখন কারোর মুভমেন্ট পাস লাগে না। লকডাউন চলমান থাকলেও চেকপোস্টগুলোতে এ বিষয়ে কিছু জানতে বা যাচাই করতে চায় না পুলিশ।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটেরিয়ামে গত ২৩ এপ্রিল দুপুরে মুভমেন্ট পাস ওয়েব সাইট উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কয়েকটি তথ্য সরবরাহ করে খুব সহজইে মুভমেন্ট পাস সংগ্রহ করতে পারবেন দেশের যেকোনো নাগরিক। তখন বলা হয়, এ ওয়েবসাইট ব্যবহার করলে একদিকে যেমন জরুরি প্রয়োজনে নাগরিকদের চলাচল নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে মানুষের অপ্রয়োজনীয় ও অনিয়ন্ত্রিত চলাচলও বন্ধ করা যাবে। এই মুভমেন্ট পাসের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
মতিঝিল এলাকার ট্রাফিক সারজেন্ট কানু লাল দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপর থেকে যে নির্দেশ আসে আমরা সেটা ফলো করি। আগে চেক করার জন্য নির্দেশ ছিল। কিন্তু এখন ওভাবে নাই তাই চেক করা হয় না।
‘লকডাউন এখন নরমাল, লাখ লাখ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে। কয়জনকে চেক করব। আমরা এখন মাস্ক ও পরিবহনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। গণপরিবহন চলাচল শুরু হলে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার দিকেও গুরুত্ব দেয়া হবে।’
লকডাউনের মধ্যে মুভমেন্ট পাস বাধ্যতামূলক করার পর প্রতিদিনই গুলশানে নিজের কর্মস্থলে যেতে এই পাস নিতে হতো মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা গোলাম আনোয়ারকে। এখন আর সেটা করতে হয় না বলে জানালেন তিনি।
নিউজবাংলাকে আনোয়ার বলেন, ‘লকডাউনের প্রথমদিকে প্রতিদিনই মুভমেন্ট পাস নিয়ে বের হওয়া লাগতো। এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও কেউ মুভমেন্ট পাস চায় না। চেকপোস্টের সামনে দিয়ে গেলেও পুলিশ মুভমেন্ট পাস দেখতে চায় না।
‘লকডাউনের শুরুতে মুভমেন্ট পাসের জন্য রাস্তায় কতোই না ঝামেলা হয়েছে। এখন সারা ঢাকা চষে বেড়ালেও এটার দরকার পড়ে না।’
মুভমেন্ট পাসকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে চিকিৎসক সাঈদা শওকত জেনির বাগবিতণ্ডা ছিল আলোচিত বিষয়
আনোয়ারের কথা সত্যি। শুরুতে মুভমেন্ট পাস নিয়ে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পুলিশের চেকপোস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসকের বাগবিতণ্ডার বিষয়টি সবার নজর কাড়ে।
বিষয়টি নিয়ে পাল্টা-পাল্টি বিবৃতি আসে চিকিৎসক ও পুলিশের বিভিন্ন সংগঠন থেকে। ওই ঘটনার পর থেকেই মুভমেন্ট পাস নিয়ে কড়াকড়ির বিষয়টি শিথিল হয়ে আসে।
চলমান লকডাউনে মুভমেন্ট পাসের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘থানা থেকে তো কাউকে মুভমেন্ট পাস দেই না। আর এই ব্যাপারে আমার কোনো এখতিয়ার নেই। এ বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’
মিরপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী লাবনী নিশাত। থাকেন মিরপুরেই। পড়াশুনার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মুভমেন্ট পাস এখন আর লাগে না। এই মুভমেন্ট পাস নিয়ে কত রঙ্গই না হলো। কত ট্রল, কত হয়রানি। একটা জিনিস শুরু করে দুই দিন পর আবার আগেই মতই চললে এই নিয়ম করে কী লাভ।’
মুভমেন্ট পাস কেন চেক করা হচ্ছে না জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের চলাচল বেড়ে গেছে। প্রথম দিকে শুধু অফিসগামী মানুষ বের হতেন। এরপর কলকারখানা, মার্কেট ও শপিংমলসহ সবই খুলে দেয়ায় মানুষের চলাচল বাড়ায় কয়জনকে চেক করব?
‘শপিংমল খোলা রেখে আমি মুভমেন্ট পাস চাইব, এটা কেমন হয়ে গেল না। এত মানুষকে দাঁড় করিয়ে মুভমেন্ট পাস চেক করার মতো আমার ফোর্সও নেই। আমরা এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি মাস্কের ওপর। মাস্ক ছাড়া কেউ বের হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাস্ক ছাড়া কোনো দোকানি থাকলে বা তার দোকানে মাস্ক ছাড়া কেউ আসলে তাদের কাছে বিক্রি করলে আমরা দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি।’
মুভমেন্ট পাস এখনও আছে, এখনও মানুষকে চেক করা হয় বলে দাবি করলেন মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মুভমেন্ট পাস এখনও আছে। মুভমেন্ট পাস নিয়ে মানুষ জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যায়। এখনও মানুষকে চেক করা হয়। আগে একটু বেশি চেক করা হতো এখন কম হয়। তবে চেক হচ্ছে।’
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমল ঘুরে দেখা যায় কোথাও মুভমেন্ট পাস চেক করা হচ্ছে না। জবাবে ডিসি আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘চেক তো আপনার সামনে করবে না। চেক করে তবে চেকটা একটু কম হচ্ছে। আর মার্কেট তো খুলে দিছে। এখন কতজনকে চেক করব। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ বের হচ্ছে। প্রত্যেকটা মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়।
‘আপনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যান তখন আপনার মুভমেন্ট পাস লাগবে। সিটিতে মুভমেন্ট পাস একটু কমে গেছে তবে সিটির বাইরে আপনি মুভমেন্ট পাস ছাড়া যেতে পারবেন না।’
মুভেমেন্ট পাস পেতে https://movementpass.police.gov.bd/ ওয়েবসাইটে আবেদন করতে হয়। ২৩ এপ্রিল থেকে বুধবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত এই সাইটে মোট হিট পড়ে ২২ কোটি ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার ১১৪টি।
মোট রেজিস্ট্রেশন করেছেন ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২০ জন। এর মধ্যে মুভমেন্ট পাস ইস্যু করা হয়েছে ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩২টি। আর ২৬ এপ্রিল থেকে ৫ মে দুপুর পর্যন্ত গড়ে মুভমেন্ট পাস ইস্যু করা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরহাদ কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যতদিন লকডাউন থাকবে, ততদিনই পুলিশের মুভমেন্ট পাস লাগবে। বিশেষ করে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার জন্য অবশ্যই মুভমেন্ট পাস লাগবে। তবে নগরীর অভ্যন্তরে চলাচলের জন্য এই পাস ব্যবহারে শৈথিল্য এসেছে। পুলিশও কাউকে চেক করছে না।’
এই পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, বর্তমানে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার জন্য মুভমেন্ট পাসের আবেদন বেড়েছে। অন্যদিকে জেলা, নগর বা শহরে যাতায়াতের মুভমেন্ট পাসের আবেদনকারীর সংখ্যা কমেছে।