ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে গত মার্চের শেষ সপ্তাহের তাণ্ডবে জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে ২০ ছাত্রের সম্পৃক্ততার তথ্য জানিয়েছে, তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি এখনও।
এদের প্রায় সবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাতেই। তবে তারা বাড়িতে নেই বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে সময় এদের নাম প্রকাশ করে, সে সময় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। ফলে তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছিল না।
গত ২৬ মার্চ এই মাদ্রাসা থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় শহরের রেলওয়ে স্টেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, আনসার ক্যাম্প। হামলা হয় পুলিশ সুপার কার্যালয়ে।
দুই দিন পর হরতালে শহরে হামলা ছিল আরও ব্যাপক। সরকারি-বেসরকারি ৩৮টি স্থাপনা ভাঙচুর করে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন। হামলা হয় শহরে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্নে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক ভাঙচুরের পরও দেয়া হয় আগুন।
প্রথমে দায় অস্বীকার, পরে চাপের মুখে নাম প্রকাশ
শুরু থেকেই তাণ্ডবে সম্পৃক্ততার তথ্যপ্রমাণ ছিল হেফাজত-সমর্থক মাদ্রাসাটির বিরুদ্ধে। তবে অস্বীকার করে আসছিল তারা।
সমালোচনার মুখে ৫ এপ্রিল শহরের প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কোনো রকম সহিংসতায় নিজেদের সম্পৃ্ক্ততা অস্বীকার করে। তারা দাবি করে, এগুলো তৃতীয় পক্ষের কাজ।
গত ২৬ মার্চ পুড়িয়ে দেয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনসেই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির নায়েবে আমির সাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২৮ মার্চ হরতালের দিন শান্তিপূর্ণ মিছিল করে ছাত্রদের নিয়ে মাদ্রাসার সামনে অবস্থান নিই। অতএব কে বা কারা এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, সরকারি স্থাপনাগুলোতে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে, তা আমি জানি না।’
সাজেদুর রহমান বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে তারা কোনো দিন হেফাজতের হতে পারে না। ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত দোষীদের বের করুন।’
তবে ১১ এপ্রিল থেকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারা সহিংসতার ঘটনায় একের পর এক গ্রেপ্তার হতে থাকলে পাল্টে যায় হেফাজত ও জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার বক্তব্য।
১৯ এপ্রিল ভিডিও বার্তায় এসে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সহিংসতার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে দ্বিতীয় দফায় দুঃখ প্রকাশ করেন হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী।
এর মধ্যে হেফাজতের এই তাণ্ডবের ঘটনায় পর্যায়ক্রমে করা হয় ৫৬টি মামলা। ৪১৪ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ব্যক্তিকে।
হেফাজতের নেতা-কর্মীরা আগুন দেয় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালেআর পুলিশ ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে একের পর এক গ্রেপ্তারের কথা জানায়। ৪ মে পর্যন্ত শহরে গ্রেপ্তার হয় মোট ৪১৪ ব্যক্তি।
এর মধ্যে আগের অবস্থান থেকে পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ২৭ এপ্রিল জামিয়া ইউনুছিয়া কর্তৃপক্ষ শহরে তাণ্ডবের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে দাওরায়ে হাদিস বিভাগের ২০ ছাত্রকে বহিষ্কার করার কথা জানায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।
সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জামিয়ায় ভর্তির পালনীয় শর্তাবলির ২৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছে শিক্ষার্থীরা। তারা মাদ্রাসার সমুদয় রীতিনীতি ও আইনকানুন অমান্য করে হুজুরদের বাধাকে উপেক্ষা করে ২৬ মার্চ বিকেলে জেলার সরকারি স্থাপনায় হামলা চালায়।’
পুলিশ ‘খুঁজে পাচ্ছে না তাদের’
জামিয়া ইউনুছিয়া কর্তৃপক্ষ ২০ ছাত্রের নাম প্রকাশ করার পর পেরিয়ে গেছে এক সপ্তাহের বেশি। হেফাজতের আরও বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু সেই ছাত্রদের কেউ ধরা পড়েনি।
তিতাস সাহিত্য সংগঠনের সভাপতি মনির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত ২৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করেই হুমকি দেয় কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদ। পরে ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত টানা ৩ দিন জেলা-উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হামলা চালিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে হেফাজতের সমর্থকরা।
‘কিছু দিন আগে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা থেকে ২০ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাণ্ডবে জড়িত থাকার অপরাধে। তবে এখন পর্যন্ত সেই ছাত্রসহ সম্মুখসারির অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ, প্রশাসনের কাছে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
২৮ মার্চ হামলা হয় সরকারি-বেসরকারি ৩৬টি স্থাপনায়জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) রইছ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত ২০ জনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু তারা এলাকায় না থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে আমরা খুব দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব।’
সেই ২০ ছাত্র যারা, যেখানে বাড়ি
জামিয়া ইউনুছিয়া তাণ্ডবকারী যে ২০ ছাত্রের নাম প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে ইফতেখার আদনান, সাইফুল ইসলাম, মো. সোলাইমান, রাকিব বিল্লাহর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডা এলাকায়।
কওমি ছাত্র ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুল্লাহ বাহারের বাড়ি শহরের মেড্ডায়।
শিব্বির আহমদের বাড়ি শহরের পাওয়ার হাউজ রোড এলাকায়।
মো. জুবায়েরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা রাজঘর গ্রামে।
আশেক এলাহি ও আবু হানিফের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বারিউরা গ্রামে।
মুবারকুল্লাহ ও বোরহান উদ্দিনের বাড়ি একই উপজেলার কুট্টাপাড়া গ্রামে।
হিজবুল্লাহ রাহমানী ও জুবায়েরের বাড়ি সরাইল উপজেলার পশ্চিম কুট্টপাড়া গ্রামে।
আব্দুল্লাহ আফজালের বাড়ি সরাইল উপজেলার সুরাজাইল গ্রামে।
রফিকুল ইসলামের বাড়ি নবীনগগর উপজেলার কুড়িঘর গ্রামে।
মিছবাহ উদ্দিন, আশরাফুল ইসলাম ও আলাউদ্দিনের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মৌজাপুর গ্রামে।
মকবুল হোসেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে।
তারেক জামিল নামে এক ছাত্রের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায়নি।