মাদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আাসমির সঙ্গে নামের আংশিক মিল থাকায় এক বছর সাড়ে চার মাস ধরে কারাগারে আছেন হাছিনা বেগম নামের এক নারী।
বিষয়টি সোমবার নিউজবাংলাকে জানান গোলাম মাওলা মুরাদ নামের এক আইনজীবী। তিনিই বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন।
মুরাদ জানান, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার মইজ্যারটেক এলাকা থেকে ২ হাজার ইয়াবাসহ হাসিনা আক্তার ও হামিদ হোসেন নামের দুজনকে আটক করে পুলিশ। এ দম্পতি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কর্ণফুলী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাসিনাকে চার বছর বয়সী ছেলে আনিস ও দুই বছরের মেয়ে নূর ফাতেমাসহ কারাগারে পাঠায় আদালত।
এরপর ওই বছরের ২৭ নভেম্বর স্বামীসহ জামিনে মুক্তি পান আসামি হাসিনা আক্তার। মুক্তির পর আত্মগোপনে চলে যান তারা।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসিনা আক্তারকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
যেভাবে গ্রেপ্তার হন হাছিনা বেগম
আইনজীবী মুরাদ জানান, ২০১৯ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদাউস চৌধুরীর আদালত মামলাটির রায়ে আসামি হাসিনা আক্তার ও তার স্বামী হামিদের ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে। অনাদায়ে আরও এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। রায়ের পর সাজা পরোয়ানা পাঠানো হয় টেকনাফ থানায়।
কিন্তু ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ মামলার আসামি হিসেবে হাসিনা আক্তারের পরিবর্তে হাছিনা বেগম নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় টেকনাফ থানা-পুলিশ।
আইনজীবী মুরাদ কীভাবে জানতে পেরেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি ভুক্তভোগীর ছেলের মাধ্যমে জানতে পেরে এ বছর ২২ মার্চ আদালতের নজরে আনি। এতে আদালত পুলিশকে বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়।
‘কিন্তু পুলিশ নানা কারণ দেখিয়ে আদালতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব করে। এর মধ্যে জেলে থাকা হাছিনা বেগম কিছুদিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন বিষয়টি পুনরায় আদালতকে অবহিত করি। এতে আদালত ৮ এপ্রিলের মধ্যে পুলিশকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেন।’
হাছিনা বেগমের মায়ের কাছে ছোট মেয়ে রোকাইয়া। ছবি: নিউজবাংলা
মুরাদ জানান, নির্দিষ্ট সময়ে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিলে দেখা যায়, মূল আসামি হাসিনা আক্তারের জায়গায় জেলে আছেন হাছিনা বেগম। হাসিনার স্বামীর নাম হামিদ হোসেন। অন্যদিকে হাছিনার স্বামীর নাম হামিদ হোছন। তবে আসামির সঙ্গে নামের ভুলে সাজা খাটা নারীর বয়স ও সন্তানের পার্থক্য রয়েছে।
মূল আসামি প্রথমবার গ্রেপ্তারের সময় তার ছোট ছোট দুইটি সন্তান ছিল। ওই নারীর বয়স তখন ছিল ৩০ বছর। কিন্তু তার পরিবর্তে জেলে থাকা হাছিনার ১৮ বছর বয়সী মেয়ে ইয়াছমিন, ১৫ বছরের ছেলে শামিম ও তিন বছরের রোকাইয়া নামের মেয়ে সন্তান আছে। তার বর্তমান বয়স ৪০ বছর।
ঘটনার বর্ণনা দেয়ার একপর্যায়ে আইনজীবী মুরাদ বলেন, ‘রোববার চট্টগ্রাম মহানগর চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে ভার্চুয়াল শুনানি হলে আমরা জেলে থাকা হাছিনা বেগমের তাৎক্ষণিক মুক্তি পরোয়ানার আবেদন করি। তবে আদালত কারা কর্তৃপক্ষকে ৪ মের মধ্যে কারা রেজিস্টারে থাকা দুজনের গ্রেপ্তারকালীন ছবিসহ রেজিস্টার বই আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে আদালত সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
কারাগার সূত্রে জানা যায়, মামলার মূল আসামি ও বর্তমান জেলে থাকা দুজনের বাড়িই কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়ায়। দুইজনের স্বামীর নামের আদ্যাক্ষর হামিদ।
জেলে থাকা নিরপরাধ হাছিনা বেগমের ছেলে শামিম নেওয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একদিন রাত দুইটার সময় আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশ আমার আম্মুকে এক সাইন দিতে হবে বলে নিয়ে যায়। তখন আমাদের বলেছিল পরদিন বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে আম্মুকে।
‘কিন্তু পরদিন থানায় গেলে পুলিশ আমাদের জানায় আমার আম্মুর নামে নাকি মামলা আছে। তাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমার ছোট বোনটার বয়স দেড় বছর। সে আম্মুকে ছাড়া থাকতে পারত না। আম্মুকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর আব্বুও আত্মগোপনে যায়৷ এখন আমার বড় বোন আর আমি মানুষের বাসায় কাজ করি। আমার ছোট বোন নানুর কাছে থাকে।’
আদালতের নির্দেশে বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয়া টেকনাফ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) খোরশেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমিসহ এই থানার অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা নতুন যোগ দিয়েছি। আগে যারা ছিলেন তারা হয়তো নাম আর স্বামীর নামের কিছু অংশ মিল থাকায় হাছিনা বেগমকে গ্রেপ্তার করেছিলেন।
‘আদালতের নির্দেশে আমি বিষয়টি অনুসন্ধান করে জানতে পারি হাছিনা বেগম নিরপরাধ। মূল আসামি হাসিনা আক্তার। দুইজনের বয়সেরও ভিন্নতা রয়েছে। তা ছাড়া হাসিনা আক্তারের স্বামী হামিদ হোসেনের বাবার নাম আব্দুল জলিল। কিন্তু হাছিনা বেগমের স্বামী হামিদ হোছনের বাবা প্রয়াত কবির আহমেদ। বিষয়গুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করে আমি আদালতে পাঠিয়েছি।’
চট্টগ্রাম কারাগারের ডেপুটি জেলার সাইমুনুর রহমান বলেন, ‘আদালতে কারা রেজিস্টার উপস্থাপন করার একটা নির্দেশনার কথা শুনেছি। তবে এখনও অফিশিয়াল কাগজপত্র আমাদের হাতে পৌঁছায়নি।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান মো. তারিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাছিনা বেগমকে মূল আসামি না হলেও জেলে থাকার বিষয়টি তিনি এত দিন কাউকে জানাননি। কয়েক দিন আগে তিনি অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপরই বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি৷
‘তা ছাড়া ২০১৭ সালে মূল আসামি হাসিনা আক্তারকে গ্রেপ্তারের সময় কারা রেজিস্টারে যে ছবি আছে এবং ২০১৯ সালে হাছিনা বেগমের যে ছবি তাতে কোনো মিল পাওয়া যায় না। তাই আমরা ধারণা করছি, জেলে থাকা হাছিনা আসল আসামি না।’
জেলার আরও বলেন, ‘আদালত যেহেতু আমাদের নির্দেশ দিয়েছে তাদের ছবি-সংবলিত রেজিস্টার আদালতে উপস্থাপন করার, আমরা সেটাই করব। বাকিটা আদালতের সিদ্ধান্ত।’