হেফাজতে ইসলামের কমিটি বিলুপ্তের একদিন পর আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে দেখা করেছেন কওমি আলেমরা। বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা রাজনীতি করবে না এমন সিদ্ধান্তসহ একাধিক বিষয় সরকারকে জানায়।
তবে গত ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মতো এবারও মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে সোজা গাড়িতে উঠে এলাকা ত্যাগ করেন কওমি নেতারা।
সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় যায় কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার প্রতিনিধি দল। রাত ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে তারা বাড়ি থেকে বের হন।
প্রতিনিধি দলের এক সদস্য নিউজবাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিনিধি দলের সদস্য জানান, গতকাল (রোববার) কওমি মাদ্রাসা নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে, তা সরকারকে জানানোর জন্য এ বৈঠক হয়।
তিনি বলেন, ‘গতকালই একটি প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা রুহুল আমিন, হাটহাজারি মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি জসিম উদ্দিন, ঢাকা আফতাবনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মো. আলী।
বৈঠকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
মুফতি রুহুল আমিনের প্রেস সচিব মোহাম্মাদ তাসনীম বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়কে আমাদের সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়েছে। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে শুনেছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে বাসভবনের সামনে হেফাজতে ইসলামের দুই জন নেতা। ছবি: নিউজবাংলা
এর আগে ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। এ সময় তারা ‘সমঝোতার’ প্রস্তাব দিলেও মন্ত্রী তাদেরকে ‘না’ করে দেন।
সোমবার রাতের ওই বৈঠকে মন্ত্রী হেফাজত নেতাদের বক্তব্যও শোনেননি বলে জানিয়েছেন সেখানে থাকা একাধিক ব্যক্তি।
বৈঠকে ছিলেন হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, খেলাফত আন্দোলনের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, তার ভাতিজা মাওলানা হাবিবুল্লাহ নিয়াজীসহ ১০ জন। ছিলেন আলোচিত নেতা মামুনুল হকের ভাই মাহফুজুল হকও।
বৈঠক শেষে হেফাজত মহাসচিব কোনো কথা বলতেই রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ।’
বৈঠক শেষে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য আসেনি। সেখানে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে কিছু তথ্য অবশ্য পাওয়া গেছে।
মন্ত্রীর দেখা পেতে সোমবার বিকেলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজতের কয়েকজন নেতা। পরে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে চা চক্রের আমন্ত্রণ পান তারা।
সোমবার রাত ১০টার দিকে হেফাজতের মহাসচিব নূরুল ইসলাম জেহাদীর নেতৃত্বে অন্তত ১০ জন নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসভবনে প্রবেশ করেন।
সে বৈঠকের আগে মন্ত্রী তার বাসায় ডাকেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন-অর-রশিদসহ গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। তাদের কয়েকজন হেফাজতের সঙ্গে মন্ত্রীর বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, বৈঠকে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নূরুল ইসলাম জেহাদী মন্ত্রীর সঙ্গে গ্রেপ্তার নিয়ে কথা বলেন। খুব নরম সুরে তিনি সমঝোতার ইঙ্গিত দেন।
গত ২৬ মার্চ হঠাৎ করেই সহিংসতা শুরু করে হেফাজত। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি আক্রান্ত হতে থাকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়
সাম্প্রতিক তাণ্ডবের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এসবের সঙ্গে জড়িত না আপনি জানেন। এটাও জানেন কারা এসব করছে, এভাবে গ্রেপ্তার চললে কীভাবে হবে?’
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব একটা কথা বলেননি।
এর মধ্যে কথা বলেন মামুনুল হকের ভাই মাহফুজুল হক। তিনি তার ভাইয়ের মামলাগুলো বিবেচনার অনুরোধ জানান। পুলিশ যেন আর রিমান্ডে নেয়ার আবেদন না করে, সে কথাও বলেন।
সব শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইন তার নিজের গতিতে চলবে, এখানে আমার কিছু করার নেই।’
মন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো আশ্বাস না পেয়ে শেষে বেরিয়ে আসার আগে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন হেফাজত মহাসচিব।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনও তাদেরকে কোনো আশা দেননি।
বৈঠকের পর দিন বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। বলেছেন, এতে পরিস্থিতি পাল্টাবে না।
আগের দিনের বৈঠকের পর মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে, দেখা করতেই পারে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখা করেছেন। কিন্তু তাতে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কোনো ব্যত্যয় হবে না।’
তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে, ধরা পড়েছেন হেফাজতের আরও এক জন নেতা। এবার ধরা পড়েছেন মাওলানা কোরবান আলী কাসেমী। তিনি ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির ঢাকা মহানগর সহসভাপতি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতায় রাজপথে নামা হেফাজত ২৬ মার্চ থেকেই ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে। সেদিন ঢাকায় সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ত্রাস তৈরি করে তা ছিল অবাক করার মতো।
দুই দিন পরের হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ৩৮টি সরকারি-বেসরকার প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয় তারা। সেদিন থেকে হামলা হতে থাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরেও।
৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রিসোর্টে মামুনুল হক অবরুদ্ধ হওয়ার পর তাকে উদ্ধার করতে গিয়েও আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয়েও হামলা করে হেফাজত কর্মীরা। হামলা হয় ছাত্র ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরেও।
কেবল সেখানে নয়, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ও সুনামগঞ্জের ছাতকেও হামলা হয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। চট্টগ্রামে আহত এক আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুও হয়।
এরপর সরকার হেফাজতকে সতর্ক করে ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় গ্রেপ্তার অভিযান। সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় ১০ জনে নেতা গ্রেপ্তার হন আট দিনের মধ্যে। আলোচিত নেতা মামুনুল হক ধরা পড়ার পর হেফাজতে উদ্বেগ এতটাই বাড়ে যে, আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ফেসবুকে ভিডিওবার্তা দিয়ে তাণ্ডবের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। মাননীয় সরকার সম্বোধন করে তিনি কোনো গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো হেফাজতের উদ্দেশ্য নয়।