করোনাভাইরাসের ভারত স্ট্রেইন নিয়ে যখন দুশ্চিন্তা, তখন দেশটি থেকে আক্রান্ত সাত ব্যক্তি দেশে এসে হাসপাতাল থেকে পলিয়ে যাওয়া তৈরি করেছে নতুন উদ্বেগ। এদের সবাইকে প্রশাসন খুঁজে ধরে এনেছে সত্য, তবে তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করার কাজটি সহজ নয়।
তবে তারা যেখানে আছেন, সেই যশোরের চিকিৎসা প্রশাসন বলছে, তাদের এখানে করোনার ভ্যারিয়েন্ট খুঁজে বের করার কোনো উপায় নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সেই সাতজনের শরীরে করোনার কোন ধরনের স্ট্রেইন রয়েছে, সেটি খুঁজে বের করতে পরীক্ষা করা হবে। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নমুনা পাঠাতে বলা হবে। ঢাকাতেই সে পরীক্ষা হবে।
তবে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়া করোনা রোগীরা এরই মধ্যে কতজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছেন, সেই প্রশ্নের জবাব জানা সম্ভব নয়।
যশোর প্রশাসন বলছে, তারা যেসব বাড়িতে গিয়েছেন, সেসব বাড়িতে নজরদারি করা হবে। কিন্তু হাসপাতালেই যেখানে তাদের ধরে রাখা গেল না, সেখানে বাড়ির লোকজনকে কতটা নজরদারিতে রাখা হবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।
করোনায় ভারতে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সোমবার থেকে ১৪ দিনের জন্য সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সারা দিনই এখন চিতা জ্বলছে ভারতে।
আর আগে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভারত থেকে দেশে আসার পর করোনা পজিটিভ প্রমাণ হওয়ার পর সাতজনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু পাহারার ব্যবস্থা না থাকায় সবাই সেখান থেকে পালিয়ে যান। বিষয়টি জানাজানি হয় রোববার। সেদিন রাতে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক প্রথমে দাবি করেন দুইজন পালিয়েছেন, পরে স্বীকার করেন দশজনের কথা। অর্থাৎ ভারত থেকে আসা সাতজনের পাশাপাশি হাসপাতালে আগে থেকে থাকা তিনজনও পালিয়ে যান।
পরে রোববার পুলিশ পাঠিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়। রাত ৮টা পর্যন্ত এদের মধ্যে ছয়জনকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, বাকিরা ছিলেন পথে।
তারা কারা
ভারত থেকে এসে যারা পালিয়েছেন, তারা হলেন যশোর সদরের পশ্চিম বালান্দিপাড়ার বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রী মনিমালা দত্ত, খুলনা সদরের সদরের কলিম কৃষ্ণের ছেলে বিবেকানন্দ, রূপসার শের আলীর ছেলে সোহেল সরদার, পাইকগাছার আহমেদ সানার ছেলে আমিরুল সানা।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার জালাল হোসেনের ছেলে মিলন হোসেন এবং কালিগঞ্জের মনতোষ সর্দারের স্ত্রী শেফালী রানীও পালিয়ে যান হাসপাতাল থেকে।
অপরজন হলেন রাজবাড়ী সদরের গোলাম রব্বানীর মেয়ে নাসিমা আক্তার।
অন্য যে তিনজন পালান তারা ভারত থেকে আসেননি। এরা হলেন যশোর সদরের পাঁচবাড়িয়া এলাকার একরামুল কবিরের স্ত্রী রুমা, রবিউল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা এবং অপরজন সদর উপজেলার ভদ্র বিশ্বাসের ছেলে সদরের প্রদীপ বিশ্বাস।
কী করছে চিকিৎসা প্রশাসন
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা পালিয়ে যাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের মধ্যে যাদের চিহ্নিত করা গেছে, তাদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে।’
তবে তাদের আইসোলশনে রাখা হয়নি জানিয়ে এই চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব বাড়িতে তারা গিয়েছে সেখানে তাদের রেস্ট্রিকটেড করেছে প্রশাসন।’
ভারতফেরত এই সাতজন করোনার কোন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত, সেটি পরীক্ষা করা হবে কি না, জানতে চাইলে ‘না’ সূচক জবাব দেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার।
একই কথা জানিয়েছেন যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আলাদাভাবে পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।’
ভ্যারিয়েন্ট জানা জরুরি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও করোনা মোকাবিলায় সরকারের পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারত থেকে আসা লোকদের শরীরে করোনার কোন ভ্যারিয়েন্ট ছিল, এটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘তারা পালিয়ে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। তাদের সংস্পর্শে যারা আসছে তাদের বের হয়ে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়াইন্টাইনে রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যদি তাদের শরীরে ভারতের ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ে, তাহলে এটা অবশ্যই শঙ্কার বিষয়। সরকারের উচিত হবে দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।’
কী করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারত থেকে আগতদের শরীরে কোন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ছিল, সেটা পরীক্ষা করা হবে। সেটা জেলাতে করা সম্ভব নয়। যে জন্য তাদের নমুনা ঢাকাতে এনে পরীক্ষা করতে হবে।’
‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবে। নমুনা হয়তো কালই ঢাকাতে নিয়ে আসা হবে। নমুনা পরীক্ষার পর কোন দেশের ভ্যারিয়েন্টে তারা আক্রান্ত এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলতে পারব।’
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের মধ্যে উদ্বেগ যে স্পষ্ট, সেটা চলমান লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোতেই বোঝা গেছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, চলমান লকডাউন যে আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে, সেটি ভারতের পরিস্থিতি দেখেই। তিনি বলেন, ‘ভারতের অবস্থাটা এত খারাপ করেছে যে, এটা নিয়ে আমরা খুব ভয় পাচ্ছি। এটা যদি বাংলাদেশে চলে আসে...ইতোমধ্যে যশোরে দুজন পাওয়া গেছে। এ কারণে এটা আমাদের সাবধানতা, আমাদের ডিসিশান।’
বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্টে কাঁপছে ভারত
করোনাভাইরাস ভারতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যে ভ্যারিয়েন্টটি সেখানে ছড়িয়েছে তার নাম দেয়া হয়েছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট।
দেশটির হাসপাতালে রোগী উপচে পড়ছে। অনেক হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার খবর আসছে। টানা পাঁচ দিন ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু তিন হাজার ছুঁই ছুঁই।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য ও সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে বেশি। গত বছর দেশে যে ভ্যারিয়েন্ট এসেছিল তার চেয়ে এই দুই ভ্যারিয়েন্ট বেশি সংক্রামক। পাশাপাশি মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে, দ্রুত অক্সিজেন সাপোর্ট এমনকি আইসিইউ লাগছে।
এর মধ্যে ভারত ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ আছে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির মধ্যে। ২৪ এপ্রিল তারা অবিলম্বে ভারত সীমান্ত বন্ধ করার পরামর্শ দেয়ার পরদিনই সরকার ১৪ দিনের জন্য ভারতের সঙ্গে যাতায়াত বন্ধ করে।