প্রয়াত আমির শাহ আহমেদ শফীর অনুসারীরা হেফাজতে ইসলামের নামেই কমিটি ঘোষণা করার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, শিগগির তারাও একটি আহ্বায়ক কমিটি করবেন। সেখানে বিতর্কিতদের বাদ দেয়া হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন থেকে শুরু হওয়া টানা এক সপ্তাহের তাণ্ডবের পর গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে রোববার রাতে আচমকা কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়ার পর শফীপন্থিরা তৎপর হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বাবুনগরী কমিটি বিলোপের সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যেই নিজেকে আমির করে পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছেন।
শফীর নেতৃত্বাধীন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী এই পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘বাবুনগরীর আহ্বায়ক কমিটি আমরা মানি না। শিগগির আমরা কমিটি ঘোষণা করব। সেখানে বিতর্কিতদের বাদ দেয়া হবে।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সদরদপ্তর হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার পর আল্লামা শফীর মৃত্যুতে হেফাজতে বিভেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এরপর ১৫ নভেম্বরের জাতীয় সম্মেলনে শফীর অনুসারী সবাইকে বাদ দিয়ে ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এর পরপরই শফীপন্থিরা নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসেন। তবে সে সময় আর এই বিষয়ে আগায়নি তারা।
তবে বাবুনগরী কমিটি বিলুপ্ত করে দেয়ার পর মাওলানা রুহী ফেসবুক লাইভে এসে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, হেফাজত তার উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়েছিল। তাই এই সিদ্ধান্ত ছিল অবশ্যম্ভাবী।
তিনি বলেন, গত ১৫ নভেম্বর তথাকথিত কাউন্সিলের মাধ্যমে অবৈধভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ এবং হেফাজতের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে বিসর্জন দিয়ে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই তথাকথিত কমিটি মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় এসে আজকে দুঃখজনকভাবে হলেও বাস্তবতা উপলব্ধি করে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন কমিটির আমির সাহেব। আমি এই কমিটি বিলুপ্ত করার যে ঘোষণা এসেছে তাকে স্বাগত জানাই।’
ইসলামের জন্য এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য হেফাজতে ইসলাম কাজ করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইনশাল্লাহ আমরা অতি শিগগির আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের নীতি আদর্শের হেফাজতে ইসলাম গঠন করব।
‘যে হেফাজতে ইসলামের কমিটি আমাদের আক্বাবীরীন। আমাদের পূর্বসূরীরা যেভাবে ইসলামকে সংরক্ষণ করেছেন, ইসলামের ভাবধারা, ইসলামের ভাবগাম্ভীর্যকে সংরক্ষণ করেছেন, সেই পথ অনুসরণ করে আমরা হেফাজতে ইসলামের কমিটি শিগগির পুনর্গঠন করব এবং সংস্কার গ্রহণ করব।’
নারী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয় হেফাজতে ইসলাম। সারাদেশে কওমি আলেমদের মধ্যে মুরুব্বি হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আল্লামা শফীকে সভাপতি ও জুনায়েদ বাবুনগরীকে করা হয় মহাসচিব।
সংগঠনটি তুমুল আলোচিত হয়ে উঠে ২০১৩ সালে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে তারা।
ওই বছরের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার ঘটনায় ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। সেদিন রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নেতাকর্মীদের উচ্ছেদের পর হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে মরদেহ গুম করার অভিযোগ করে সংগঠনটি।
তবে পরে এই অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি হেফাজতের পক্ষ থেকে নিহত হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়েছিল তারা পরে ফিরে এসেছেন।
অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও ওই ঘটনার পর থেকে হেফাজতের রাজনৈতিক গুরুত্বও তৈরি হয়।
পরে শাহ আহমদ শফী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। আর কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় আহমদ শফীকে।
তবে গত ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার পর দিন আল্লামা শফী মারা যান হাসপাতালে। এই মৃত্যুকে হত্যা অভিযোগ করে আদালতে গত ডিসেম্বরে মামলা করেন প্রয়াত হেফাজত নেতার শ্যালক মাওলানা মাঈনুদ্দীন। সম্প্রতি বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে আসামি করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
শফীর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা হেফাজতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। আর এর মধ্যেই নতুন সম্মেলনের ডাক দেয়া হয় ১৫ নভেম্বর।
এই সম্মেলনকে অবৈধ দাবি করে শফীপন্থিরা বলে আসছিলেন, হেফাজত বিএনপি-জামায়াতের দখলে যাচ্ছে।
পরে সম্মেলনে শফীপন্থি ছাড়াও যারা বিএনপি-জামায়াত জোট ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এই কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সাবেক কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা রুহী, আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী। বাদ পড়েন আগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা মুফতি ফয়জুল্লাহও।
বাদ দেয়া হয় জামায়াতের কট্টর সমালোচক চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমকেও। তিনি আগের কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন।
তবে ২০ দল ছাড়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে অন্য দলে যোগ দেয়া জুনায়েদ আল হাবিবকে ঠিকই কমিটিতে রাখা হয়। তাকে করা হয় ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি।
বাবুনগরীর কমিটিতে ২০ দলের যারা ছিল
নতুন কমিটিকে যাদেরকে রাখা হয়, তাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে, তারা সবাই বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট ২০ দলের শরিক।
ওই কমিটির মহাসচিব করা হয় নূর হোসাইন কাসেমীকে। তিনি বিএনপি জামায়াত জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর একাংশের নেতা। পরে তিনি মারা যান।
দলের নেতা মাওলানা জিয়াউদ্দীন, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক জায়গা পান সংগঠনের উপদেষ্টামণ্ডলীতে।
নায়েবে আমির পদে জমিয়তের ছয়জন নেতা জায়গা পান। তারা হলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ (মধুপুর) মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সাদী, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, মাওলানা আনোয়ারুল করিম (যশোর) ও মাওলানা নুরুল ইসলাম খান (সুনামগঞ্জ)।
নতুন চার যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন এই দলের। তারা হলেন মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির।
সহকারী মহাসচিব হন মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।
সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক হন মাওলানা মাসউদুল করীম, মাওলানা শামসুল ইসলাম জিলানী ও মাওলানা তাফহিমুল হক।
অর্থ সম্পাদক হন মুফতি মুনির হোসাইন কাসেমী ও সহকারী অর্থ সম্পাদক মাওলানা লোকমান মাজহারী।
সহকারী প্রচার সম্পাদক হন মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী, মুফতি শরীফুল্লাহ ও মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান।
আইন বিষয়ক সম্পাদক হন মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ নির্বাচন করেছেন।
দাওয়াহ সম্পাদক হন মাওলানা নাজমুল হাসান, সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক হন মাওলানা শুয়াইব আহমদ, মাওলানা গোলাম কিবরিয়া, সহকারী দপ্তর সম্পাদক হন মাওলানা সিদ্দিকুল ইসলাম তোফায়েল।
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন জামিল আহমদ চৌধুরী, বশির আহমদ, তাফাজ্জল হক আজিজ, আলী আকবর সাভার, আবু আব্দুর রহিম, আব্দুল কুদ্দুস, মুহাম্মদ উল্লাহ জামি, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী।
বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক খেলাফত মজলিসেরও ছয়জন নেতা স্থান পান কমিটিতে। এদের মধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে ছিলেন দলের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক। নায়েবে আমির হন আহমাদ আবদুল কাদের, যিনি ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন।
এই দলের মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন হন নায়েবে আমির।
সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক হন মাওলানা আবদুল কাদের সালেহ ও আহমদ আলী কাসেমী।