সাভারে রানা প্লাজা ধসের আট বছরেও ক্ষতিপূরণ পাননি নিহতদের স্বজন ও আহত শ্রমিকরা। এ জন্যে সরকার ও বিজিএমইএকে দায়ী করছেন তারা।
২০১৩ সালের এই দিনে সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। আহতদের মধ্যে পঙ্গু হয়ে যান কমপক্ষে ১ হাজার ১৬৯ জন।
দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির অষ্টম বার্ষিকী আজ।
নির্মম এ ঘটনার এত বছর পেরোলেও ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসনের দোলাচলে রয়েছেন নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য ও আহতরা। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও সরকার কিংবা বিজিএমইএ তাদের কোনো খোঁজ নেয়নি। আর দোষীদের বিচারের নামেও তাদের সঙ্গে চলছে প্রহসন।
এখানেই ছিল রানা প্লাজা। নয় তলা ভবনটির ধসের স্থানটি এখন পরিত্যক্ত জমিতে পরিণত হয়েছে। ছবি: নিউজবাংলা
ঘটনার দিন রানা প্লাজার চতুর্থ তলায় আয়রনম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন ইমাদুল ইসলাম এমদাদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৩ এপ্রিল আমরা রানা প্লাজায় আসছিলাম, ডিউটি করছি। ওই দিন মূলত সকাল ১০টার সময় আমাদের বলে যে, বিদ্যুতের সমস্যা। এই জন্য আমাদের সাধারণ ছুটি দেয়া হয়।
‘পরদিন ২৪ এপ্রিলে মাইকিং করে আমাদের সবাইকে জড়ো করা হয়। তখন মালিকপক্ষের কিছু গুন্ডা বাহিনী জোর করে আমাদের গার্মেন্টের ভিতর কাজ করতে ঢোকায়। ওই দিন পৌনে এক ঘণ্টা ডিউটি করার পর একটা বিকট শব্দ হয়। শব্দটা শোনার পরেই দেখি রানা প্লাজা ভাইঙ্গা পড়ছে আমাদের উপরে।’
‘ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পর আমাকে উদ্ধার করা হয়। জ্ঞান ফিরে দেখছি আমি এনাম মেডিক্যালে ভর্তি আছি। মৃত্যুযাত্রা থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেও শারীরিক কারণে আমি বেকার হয়ে পড়ি। আমি এখন পিজি হাসপাতালের চিকিৎসার আওতায় আছি।’
ইমাদুল ইসলাম এমদাদ এখন রানা প্লাজা গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার থেকে কিছু আর বিভিন্ন এনজিও থেকে কিছু অনুদান দিছিল। কিন্তু আমাদের নামে যে ১২২ কোটি টাকার ফান্ড ছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। সেই খান থেকে ২২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে, যা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে সংবাদ পাইছি। কিন্তু বাকি ১০০ কোটি টাকার হিসাব চাইলে কোনো হিসাব দিচ্ছে না।’
রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর নির্মিত হয় অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: নিউজবাংলা
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদারও একই দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক দিনের বেতন কেটে ১২২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই অর্থে রানা প্লাজার নামে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে একটি ফান্ড তৈরি করা হয়।
‘সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে ২২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা হিসেবে শ্রমিকদের দেয়া হয়েছিল। তবে বাকি এক শ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। যদি এই অর্থ আপাতত ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দেয়া হয় তাহলে এই দুই হাজার পরিবারের সবার জন্যই যথেষ্ট হবে।’
নিলুফা ইয়াসমিন নামে আরেক শ্রমিক বলেন, ‘ওই দিন আমি চারতলায় কাজ করতেছিলাম। গার্মেন্টসটা ভাইঙ্গা পড়ার আগে আমরা লাইনচিফ, সুপারভাইজারকে বলছিলাম, কি সমস্যা হইছে? তারা বলছে, কিছুই হয় নাই। কিছুই যদি না হয় তো নিচতলার ব্যাংক, মার্কেট ওদের আগে থাইকা কেন সরায় দেয়া হয়। তাইলে আমাগো আগেভাগে জানাইলে কি হইছিল?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ওই দিন না আসলে সবাই বাইচা যাইতাম। এটা মালিকদের ষড়যন্ত্র। আমরা দোষীদের বিচার চাই।’
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘আমরা দেখছি রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পূর্তি হলেও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টা নিশ্চিত করা হয় নাই। তাদের পুনর্বাসন ও সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয় নাই। বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় নাই।
‘২০১৩ সালে রানা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই দেশি-বিদেশি সংস্থা শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দেয়া এই অর্থকেই এখন দেশের কিছু লোক ও বিজিএমইএ ক্ষতিপূরণ বলার চেষ্টা করতেছে। এটা কোনোভাবেই ক্ষতিপূরণের টাকা হতে পারে না। এটা অনুদানের অর্থ।’
‘রানা প্লাজা ধসের অষ্টম বছরে এসেও আমরা বলতেছি অনুদানের অর্থে নয়, সরকারি অর্থেই হতে হবে রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন।’
তিনি আরও বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের সেই স্থানটিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশেই শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্থায়ীভাবে একটা ভাস্কর্য বা বেদি নির্মাণ করতে হবে, যাতে আমরা প্রতিবছর সেখানে গিয়ে সেই রানা প্লাজার শ্রমিকদের স্মরণ করতে পারি।’