তাণ্ডব চলেছে মার্চের শেষে। আর এর প্রতিবাদে পদত্যাগ হলো এপ্রিলের শেষে। আবার ঘোষণাটি এমন সময় এল যখন সহিংসতায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে একের পর এক নেতা যাচ্ছেন কারাগারে, রিমান্ডে।
শুক্রবার হেফাজতে ইসলামীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার আলোচিত নেতা আব্দুর রহিম কাসেমী সংবাদ সম্মেলন করে হঠাৎ করেই ঘোষণা দিলেন, তিনি আর তার সংগঠনের সঙ্গে নেই। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত হেফাজতের যে ত্রাস চলেছে, তাতে সম্পৃক্তদের বিচারও দাবি করেন।
কাসেমী ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজত ইসলামের জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
তার আচমকা পদত্যাগের বিষয়টি হেফাজতে আলোচনা তৈরি করেছে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা পেতে এই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
নিউজবাংলার সঙ্গেও কথা হয়েছে এই কওমি আলেমের।
-ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাণ্ডবের ঘটনায় হেফাজত সম্পৃক্ততা কতুটুক আপনি মনে করেন?সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তা আপনারা দেখেছেন।’
২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে উন্নয়ন মেলায় হেফাজত কর্মীদের তাণ্ডবের চিত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে কওমিপন্থিদের সংঘর্ষ যখন শান্ত হয়ে আসে, তখন চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্রাস তৈরি করে হেফাজত সমর্থকরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাশে হেফাজতপন্থিদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা থেকে মিছিল নিয়ে ছাত্ররা হামলে পরে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় পুড়ে যায় স্টেশনের সংকেত ব্যবস্থা। পানি উন্নয়ন বোর্ডে রাখা গাড়িগুলোও পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।
সন্ধ্যায় হামলা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও। তখন গুলি চালায় পুলিশ আর এতে একজন নিহত হয়।
২৭ মার্চ মহাসড়ক অবরোধ করে আবার পুলিশের ওপর হামলা হলে চলে গুলি। সেদিন মারা যায় আরও অন্তত ছয় জন।
আর ২৮ মার্চের হরতালে তাণ্ডব ছিল অবিশ্বাস্য। সরকারি-বেসরকারি ৩৮টি স্থাপনা বিশেষ করে ভূমি অফিসে আগুনে সব কিছু পুড়িয়ে দেয়ার বহু বছর ভুগতে হবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে।
সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনার পাশাপাশি হেফাজত কর্মীরা ভাঙচুর চালায় বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরালেও
হামলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্নে। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, শহিদ মুক্তিযোদ্ধদের নামফলক, কিছুই বাদ যায়নি।
-এত উচ্ছৃঙ্খলার কী কারণ?
কাসেমী বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের ঘটনার পূর্বে আমাদের নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন করেছি এবং আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের রেখেছি। আর ওনারা আন্দোলন করেছেন, কিন্তু আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। এই জন্য পালাক্রমে অনেক কিছু ঘটে গেছে।’
২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে কর্মসূচি নির্ধরণে জামিয়া ইউনুসিয়ার শিক্ষক ও হেফাজত নেতাদের যে বৈঠক, হয়, সেখানেও দেখা গেছে কাসেমীকে। তবে এ বিষয়ে তিনি এখন কিছু বলছেন না।
সে সময় কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, হেফাজত ত্রাস তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানেই। আর শুরুতে সরকার সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে মামুনুল হককে নিয়ে ঘটনাপ্রবাহের পর হেফাজতের আবার সহিংস হয়ে উঠার পর সরকার বিরক্ত হয়।
হেফাজত কর্মীদের তাণ্ডবের শুরু হয় ২৬ মার্চ। সেদিন তারা জেলা রেল স্টেশনে আগুন দেয়ায় নষ্ট হয়ে যায় সংকেত ব্যবস্থা
১১ এপ্রিল থেকে হেফাজতের একের পর এক নেতা গ্রেপ্তার হতে থাকে। ১২ দিনের মধ্যে ধরা পড়েন ১৮ জনের মতো শীর্ষ নেতা। সাম্প্রতিক তাণ্ডবের পাশাপাশি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর অবস্থান ঘিরে সহিংসতার মামলাগুলোও আবার সচল হতে শুরু করে।
প্রায় এক মাস পর পদত্যাগ আত্ম উপলব্ধি নাকি গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা- জানতে চাইলে মাওলানা কাসেমী বলেন, ‘আমার কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত নেতাগণ আমার উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
‘আমি এই কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না থাকার শর্তেও হেফাজতের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার নাম গ্রেপ্তারের তালিকায় দেয়ার প্ররোচনা করছে বলে আভাস পেয়েছি। তাই আজকে লিখিত বক্তব্যে মাধ্যমে আমি আমার বিষয়টি পরিষ্কার করলাম যে হেফাজতের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
তাহলে আপনি গ্রেপ্তার হতে চান না বলেই এই কাজ করলেন-আবার প্রশ্ন করা হয় কাসেমীকে।
জবাবে বলেন, ‘গ্রেপ্তার বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে কেন্দ্রীয় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে হেফাজতের কর্মকাণ্ড চলছে তা নিয়ন্ত্রণহীন। কাজেই এই কারণে আরও কিছু অঘটন ঘটবে।’
‘মামুনুল হক তো বিবেকহীন’
মামুনুল হক রিসোর্টে কাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে বিতর্কে যেতে চান না মাওলানা কাসেমী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যে সময় তিনি সময় কাটাতে গিয়েছিলেন, সেই সময় তার সেখানে যাওয়া সমীচিন হয়েছে কি না।
তিনি বলেন, ‘বায়তুল মোকাররমে, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ নানা জায়গা অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে মাওলানা মামুনুল হক সাহেব তিনি রিসোর্টে যান বিবিরে নিয়ে। এটি কীভাবে সম্ভব?
মাওলানা কাসেমী বলেছেন মামুনুল হক বিবেকহীন না হলে ওই পরিস্থিতিতে রিসোর্টে যেতে পারবেন না
‘তখনও গুলিবিদ্ধ লাশগুলো দাফন হয়নি। সবগুলো লাশ তখনও দাফন হয়নি, মামুনুল হক সাহেব তার এই কার্যক্রমের দ্বারা প্রমাণ করে দিল তিনি একজন বিবেকহীন মানুষ। তাদের দ্বারা কী করে চলবে হেফাজতের কার্যক্রম?’
অভিযোগ কাসেমীর বিরুদ্ধেও
২৮ মার্চ হেফাজতের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারও। সেদিন তার ব্যক্তিগত কার্যালয় তছনছ করেছে কওমি ছাত্ররা। তিনি বেঁচে গেছেন সেখানে ছিলেন না বলে।
মাওলানা কাসেমীর হেফাজত থেকে সরে যাওয়ার খবর শুনেছেন তিনিও। আর তিনি এই কওমি আলেমকে ছাড় দেয়ার পক্ষে নন।
নিউজবাংলাকে আল মামুন সরকার বলেন, ‘হেফাজতের তাণ্ডবে আব্দুর রহিম কাসেমী সরাসরি জড়িত। তাণ্ডবের আগে হেফাজতের বিভিন্ন সভায় তার উপস্থিতি রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এখন তিনি গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে এসব কথা বলছেন বলেই আমি মনে করি।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) রইছ উদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, ‘হেফাজতের তাণ্ডবের পূরো ঘটনার ভিডিও ফুটেজ চেক করা করে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে মাওলানা কাসেমীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’