লকডাউনের মধ্যে ঢাকার সড়কে এক চিকিৎসকের মুভমেন্ট পাস নিয়ে বিতণ্ডায় জড়ানো ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশীদকে বরিশালে বদলি করা হয়েছে।
সহকারী কমিশনার পদে ঢাকা জেলা প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তাকে বদলি করার বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন।
তিনি বলেন, ‘উনাকে বদলি করা হয়েছে, বরিশালে।’
ওই আলোচিত ঘটনার চারদিনর পর তাকে বদলির খবরটি গণমাধ্যমে এলো।
গত ১৮ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের পরিচয়পত্র দেখা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে এক চিকিৎসকের তর্কযুদ্ধের সময় সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দায়িত্বপালন করছিলেন এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
- আরও পড়ুন: লকডাউনে এবার ডাক্তার-পুলিশ বিতর্কে তোলপাড়
- আরও পড়ুন: এ দেশ ছেড়ে যাব তো আমরা: ডা. জেনি
সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে এই বদলি কি না- চানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না। এর মধ্যে কোনো ঘটনার প্রেক্ষিত নেই। তার বদলি সময় হয়েছে, এজন্য তাকে বদলি করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে মামুনুর রশীদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
যা ঘটেছিল
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে দুপুরের দিকে একটি প্রাইভেটকার থামান নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এ কাইয়ুম। গাড়ির আরোহীর কাছে জানতে চান মুভমেন্ট পাস আছে কি না। ভেতরে থাকা নারী নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে বলেন তার জন্য পাস দরকার নেই।
এরপর শুরু হয় তর্কাতর্কি।
ওই চিকিৎক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক (রেডিওলজিস্ট) সাঈদা শওকত জেনি। তিনি নিজেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পরিচয় দিয়ে রাগারাগি করেন। বলেন, তার কেন পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
পুলিশ কর্মকর্তা ওই চিকিৎসককে ভুয়া বললে তিনি আরও ক্ষেপে যান। এক পর্যায়ে ওই চিকিৎসককে অবৈধ যৌন ব্যবসার অভিযোগে গ্রেপ্তার শামীমা নূর পাপিয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
- আরও পড়ুন: ডা. জেনিকে ‘পাপিয়া’ বলা ওসির শাস্তি দাবি
- আরও পড়ুন: জরিমানার পর ডাক্তার দম্পতিকে জেলে নেয়ার হুমকি পুলিশের
তখন ডা. জেনি বলেন, তিনি একজন বীর বিক্রমের মেয়ে।
পরে নিউমার্কেট থানার ওসি বলেন, তিনিও বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক (রেডিওলজিস্ট) সাঈদা শওকত জেনি
এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসেন ওইখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী হাকিম শেখ মো. মামুনুর রশীদ। তিনিও নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবি করেন।
তাকে কাছে পেয়ে চিকিৎসক জেনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, তার কাছে এসে ‘সরি’বলতে হবে। ডাক্তারদের সঙ্গে পুলিশ যাচ্ছেতাই আচরণ করছে, হয়রানি করছে।
ওই ম্যাজিস্ট্রেট পরে ঘটনাটি মিটমাট করার চেষ্টা করেন। আর আধা ঘণ্টা পর চিকিৎসক জেনি ঘটনাস্থল ছেড়ে যান।
এ ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, ওই নারী চিকিৎসকের পরিচয়পত্র দেখতে চান পুলিশ সদস্যরা। তখন উত্তেজিত হয়ে পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করতে দেখা যায় ওই চিকিৎসককে।
সেদিন ম্যাজিস্ট্রেট মামুন যা বলেছিলেন
শেখ মো. মামুনুর রশীদ সেদিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে ডাক্তার বললে আমরা আইডি কার্ডটা দেখছি, ছেড়েও দিচ্ছি। যাদের কার্ড নেই তারা অনেকেই ভিজিটিং কার্ড দেখাচ্ছেন, আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। ওনাকে ওসি সাহেব কার্ডটা দেখতে চেয়েছিল। এরপর ডাক্তার উত্তেজিত হয়ে যান। তারপর আমাকে ডেকে নেন।’
কিন্তু অ্যাপ্রোন পরা বা গাড়িতে সিল থাকার পরও কি আইডি কার্ড চেক করার কোনো কারণ ছিল?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে এখন তো অনেকেই এমন ভুয়া পরিচয় দিয়ে থাকেন। ভুয়া ডাক্তার আমরা দুই একজন পাচ্ছি। সবাই তো সব সময় আইডি কার্ড নিয়ে বের হয় না। কিন্তু ওনার কাছে আইডি কার্ড চাওয়া হলেই উনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন।’
ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে বরিশাল বদলি হওয়া ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশীদ
পরিস্থিতি কীভাবে সামলেছেন, সেটিও জানান ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বলেন, ‘আসলে আমি ওই সময় শুধু ওনাদের দুইজনের কথা চিন্তা করিনি। আমি চিন্তা করেছি সারা দেশের। যদি কোনো একটা অঘটন ঘটে তবে অন্য রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেত। পুলিশ একটা ঝামেলা করবে আবার ডাক্তাররাও একটা ঝামেলা করবে। তাই আমি চেষ্টা করছি বিষয়টি সমঝোতা করে ফেলতে।
‘ওসিকে আমি বুঝিয়েছি। ওনার (ডাক্তারের) সাথে আরেকজন ছিলেন। পরে তার সাথে কথা বলে তাকেও বুঝিয়েছি। এরপর বিষয়টি এভাবেই সমাধান হয়েছে।’
সেই ঘটনায় পুলিশ-ডাক্তার দ্বন্দ্ব
১৮ এপ্রিলের সেই ঘটনাটি এর আগের বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে। ১৪ এপ্রিল লকডাউন শুরুর হওয়ার পর পরিচয়পত্র দেখেও পুলিশ স্কয়ার হাসপাতালের এক চিকিৎসককে জরিমানা করে। সেদিন এক চিকিৎসককে ‘কসাই’ সম্বোধন করার অভিযোগও আছে।
আবার দুই জন চিকিৎসকের গাড়িচালককে জরিমানা করা হয়েছে। তারা চিকিৎসকদেরকে কর্মস্থলে দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। একটি ঘটনায় চিকিৎসক নিজে পুলিশের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে তাকে বলা হয়েছে, বেশি কথা বললে জেল দেয়া হবে।
- আরও পড়ুন:জেনির বিরুদ্ধেই ব্যবস্থার দাবি পুলিশ কর্মকর্তাদের
- আরও পড়ুন: হয়রানি চললে সেবা ব্যাহত হবে, সরকারকে চিঠি
এর মধ্যে ডা. জেনির সঙ্গে ওই ঘটনাটি আগুনে ঘি ঢালে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে তার তুলনাকে মেনে নিতে পারেননি চিকিৎসকরা। নিউমার্কেট থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবিতে বিবৃতি আসে গণমাধ্যমে।
এ ঘটনার পর চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তাদের হয়রানি করা হলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে।
বিপরীতে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতে এই ঘটনায় ডা. জেনিদে দায়ী করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আর্জিও জানানো হয়েছে।
ঘটনার প্রেক্ষিতে এক ব্রিফিংয়ে চিকিৎসকদের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার জন্য আহ্বান জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি সড়কে চিকিৎসকদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।