রাজধানীতে যোগাযোগ ব্যাবস্থা গতিশীল করতে মেট্রোরেলের এক সেট ট্রেনের কোচ ডিপোতে নেয়া শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে ক্রেন দিয়ে কোচ লরিতে তোলার কাজ শুরু হয়। পরে কোচগুলো দিয়াবাড়ির ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হয়।
উত্তরার দিয়াবাড়িতে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি করা বিশেষ জেটিতে রাখা হবে এটি। আজ সারাদিন একই লরিতে করে মোট চারটি কোচ ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হবে। জেটিতে অবস্থানরত বাকি দুটি কোচ নামিয়ে কাল শুক্রবার সকালে ডিপোতে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এ বি এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মেট্রোরেলের প্রথম কোচ ট্রেইলারের উপর আনলোড করেছি। এরপর আমাদের বিশেষ ডিপোতে নেয়ার পর ওয়ার্কশপে তোলা হবে।
‘সেখানে আমরা কোচগুলোর কারিগরি কাজ করব। কোচগুলোর ক্ষেত্রে অন্যান্য ইন্টারনাল টেস্ট ছাড়াও ১৯টি টেস্ট করা হবে। এরপর ছয়টি কোচ জোড়াদিয়ে ফুল ট্রেন ফরম করা হবে। সেটার পর আবার পরীক্ষা হবে। এভাবে সব কারিগরি বিষয় পরীক্ষা করে দেখার পর আমরা ফাইনালি ডিএমটিসিএল এর কাছে হস্তান্তর করব।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোন যন্ত্রের ডিফল্ট থাকে সে ক্ষেত্রে স্পেয়ার পার্টস আনা হয়েছে। তা ছাড়া জাপানি যে কোম্পানি এগুলো সরবরাহ করছে তাদের কুইক রেসপন্স টিমের সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনিং টিম আছে। তা ছাড়া এটি জাপান থেকে টেস্ট হয়ে এসেছে। পথের মধ্যেও কোন সমস্যা হয়নি। সুতরাং আশা করি সেটআপে কোনো সমস্যা দেখা যাবে না।’
এর আগে বুধবার বিকেলে দুটি বার্জ দিয়ে এক সেট ট্রেনের মোট ছয়টি কোচ ঢাকায় এসেছে। পাঁচটার দিকে ট্রেনবাহী প্রথম বার্জটি মোংলা বন্দর থেকে ঢাকার উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপোর কাছে নদীর জেটিতে ভেড়ে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আরেকটি বার্জ জেটিতে আসে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) অধীনে ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প (লাইন-৬) বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাপান থেকে ট্রেনের কোচের পাশাপাশি তা বার্জ থেকে নামানোর যন্ত্রও আনা হয়েছে। বুধবার এসব যন্ত্র খালাস করা হয়।
প্রকল্প নথি অনুসারে, জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়ামকে ২৪ সেট ট্রেন নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় ২০১৭ সালে। দুই পাশে দুটি ইঞ্জিন আর চারটি কোচের সমন্বয়ে ট্রেনের সেটগুলো তৈরি হচ্ছে জাপানে।
এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়েছে পাঁচ সেট ট্রেন, যার প্রথমটি দেশে এসে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় সেট জাপান থেকে ১৫ এপ্রিল রওনা হওয়ার কথা। সেটি পৌঁছাতে পারে আগামী ১৬ জুন। আর তৃতীয় সেট ১৩ জুন রওনা দিয়ে ১৩ আগস্ট পৌঁছাতে পারে। বাকি দুটি সেটের আসার সময়সীমা এখনো ঠিক হয়নি।
সব মিলিয়ে ২৪ সেট ট্রেনের দাম পড়ছে ৩ হাজার ২০৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। শুল্ক ও ভ্যাট মিলিয়ে এসব ট্রেন বাংলাদেশে আনার পর মোট খরচ হবে ৪ হাজার ২৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
ট্রেনগুলোয় ডিসি ১৫০০ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা থাকবে। স্টেইনলেস স্টিল বডির ট্রেনগুলোয় থাকবে লম্বালম্বি সিট। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে দুটি হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রতিটি বগির দুই পাশে থাকবে চারটি করে দরজা।
তুরাগতীর থেকে লরিতে তোলা হচ্ছে মেট্রোরেলের কোচ। ছবি: নিউজবাংলাজাপানি স্ট্যান্ডার্ডের নিরাপত্তাব্যবস্থা-সংবলিত প্রতিটি ট্রেনের যাত্রী ধারণক্ষমতা হবে ১ হাজার ৭৩৮ জন। ভাড়া পরিশোধের জন্য থাকবে স্মার্ট কার্ড টিকিটিং ব্যবস্থা।
মেট্রোরেলের কোচগুলো তৈরি হয়েছে জাপানে। এরপর বড় জাহাজে ভরে জাপানের কোবে বন্দর থেকে গত ৪ মার্চে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে পৌঁছায় ৩১ মার্চ। এরপর শুল্ক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঢাকার পথে বার্জে করে যাত্রা করে। কোচগুলো পৃথক পৃথক আচ্ছাদন দিয়ে মুড়িয়ে আনা হয়েছে।
সার্বিক কাজের অগ্রগতি
মেট্রোরেলের পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ রয়েছে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে। সে অনুযায়ী শ্রমিকরা দিনরাত শ্রম দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন মেট্রোরেলের কাজ।
ডিএমটিসিএল-এর সর্বশেষ তথ্যমতে, রাজধানীর প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পের (এমআরটি লাইন-৬) নির্মাণকাজের অগ্রগতি এসেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম ভাগ উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি ৮৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
ডিএমটিসিএল সূত্র আরও জানিয়েছে, ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ১৩ দশমিক ২৭৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট এখন দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে ডিপোর ভিতরে ১৬ দশমিক ৯০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া ভায়াডাক্টের উপরে ১০ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক প্লেট কাস্টিং সম্পন্ন হয়েছে। রোড কাম রেল ভেহিক্যাল ব্যবহার করে ডিপোর অভ্যন্তরে এবং ভায়াডাক্টের উপরে ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে ডিপোর ভিতরে ৬ কিলোমিটার ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম স্থাপন হয়ে গেছে।
দিয়াবাড়ির মেট্রোরেল ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জাপান থেকে আসা কোচ। ছবি: সাইফুল ইসলামডিএমটিসিএল-এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন মতে, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের প্লাটফর্ম নির্মাণকাজ শেষ। উত্তরা উত্তর স্টেশনের প্লাটফর্ম নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। উত্তরা উত্তর ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে স্টিল স্ট্রাকচার ইরেকশন কাজ চলমান। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনে বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন এবং স্টেশন কন্ট্রোলার কক্ষ নির্মাণকাজও চলমান। এ ছাড়া উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের ছাদ নির্মাণের কাজ চলছে। মেট্রোরেল নির্মাণে স্বাভাবিক পানির প্রবাহ ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেই বিবেচনায় পাঁচটি লং স্প্যান ব্যালান্স ক্যান্টিলিভারের মধ্যে তিনটির কাজও ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
চলবে ২৪ ট্রেন
ঢাকার যানজট নিরসনসহ নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে এই মেট্রোরেল প্রকল্পের মাধ্যমে সব কটি পয়েন্টে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। প্রত্যেকটি ট্রেনে থাকবে ৬টি করে কার বা কামরা। এই ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় এক শ কিলোমিটার। প্রতি ৪ মিনিট পরপর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল। চলাচল শুরু হলে উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের।
মেট্রোরেলের কোচ তুরাগতীর থেকে নেয়া হচ্ছে দিয়াবাড়ির ডিপোতে। ছবি: সাইফুল ইসলামভাড়া হবে কত
মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দূরত্ব ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া হতে পারে ২ টাকা ৪০ পয়সা। ডিএমটিসিএল প্রাথমিকভাবে এই হারে ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনা করছে। এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দূরত্বে যেতে ভাড়া আসবে ৪০ টাকা ২৫ পয়সা।